আমার নাম নায়ীরা।
ড. ইলাক কোনো কথা না বলে শরীরের অভ্যন্তরে রক্তনালি ও নার্ভন্তু পরীক্ষা করার যন্ত্রটি নিয়ে নায়ীরার ওপরে ঝুঁকে পড়ল। নায়ীরা মনে মনে ফিসফিস করে নিজেকে বলতে থাকে, আমি নায়ীরা। আমি নায়ীরা, ক্লোন প্রক্রিয়ায় আমার সৃষ্টি করা হতে পারে, কিন্তু আমি মানুষ। আমি শতকরা এক শ ভাগ মানুষ। আমি মানুষ নায়ীরা।
.
নায়ীরা তার ঘরের ছোট জানালার সামনে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। বিজ্ঞান কেন্দ্রে আসার পর যখন তার শরীরকে নানা যন্ত্রপাতি দিয়ে বিশ্লেষণ করা না হয় তখন তাকে এই ঘরটির ভেতর থাকতে হয়। ঘরটি অপূর্ব, খুব আরামে থাকার জন্য একটা ঘরে যা যা থাকা প্রয়োজন এখানে তার সবকিছু আছে, কিন্তু তবুও সে হাঁপিয়ে ওঠে। তার খুব সৌভাগ্য যে তাকে একটা ভিডিও স্ক্রিন দেওয়া হয়েছে, সেটি এখানকার মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া আছে। নায়ীরা নিশ্চিত, তথ্যকেন্দ্রের খুব ছোট এবং অপ্রয়োজনীয় একটি অংশ সে। দেখতে পায়। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সত্যিকার তথ্য তার কাছ থেকে সযত্নে আড়াল করে রাখা হয়েছে। যেটুকু দেখতে পায় সেটুকুই সে খুব আগ্রহ নিয়ে দেখে।
দরজায় খুট করে একটি শব্দ হল, নায়ীরা ঘুরে তাকিয়ে দেখে মধ্যবয়স্ক পরিচারিকাটি তার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিতে দিতে বলল, তুমি কিন্তু ঠিক করে খাচ্ছ না।
আমি একা একা খেয়ে অভ্যস্ত নই। নায়ীরা একটু হেসে বলল, তুমি আমার সঙ্গে খাবে?
পরিচারিকাটি হাসল, বলল, উঁহু। নিয়ম নেই।
নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, শুধু নিয়ম আর নিয়ম। এত নিয়ম আমার ভালো লাগে না।
ভালো না লাগলেও মানতে হয়। আজকে খাওয়া শেষ কর। ফলের রসটুকুতে একটা অন্যরকম ঝুঁজ দেওয়া হয়েছে, দেখবে খুব মজার।
দেখব। নিশ্চয়ই দেখব।
খাওয়া শেষ করে প্রস্তুত থেকো। তোমার সঙ্গে আজকে দীর্ঘ সেশন হবে।
চমৎকার। নায়ীরা বলল, এই চার দেয়ালের ভেতর আমি হাঁপিয়ে উঠছি।
পরিচারিকাটি চলে যাওয়ার পর নায়ীরা আবার জানালার কাছে এগিয়ে যায়। তার এখন খেয়ে প্রস্তুত হয়ে নেওয়ার কথা। কিন্তু তার কিছু করার ইচ্ছে করছে না। ঘুরেফিরে তার শুধু তার বোনদের কথা মনে পড়ছে। এগার জন মিলে ছিল তাদের অস্তিত্ব। এখন সে একা। এই নিঃসঙ্গতাটুকু যে কী ভয়ানক সেটা কি কেউ কখনো জানতে পারবে? গভীর বিষাদে নায়ীরার বুকের ভেতরটুকু হাহাকার করতে থাকে।
.
একটি কালো গ্রানাইটের টেবিলের একপাশে নায়ীরা বসেছে, তার সামনে চার জন মানুষ। দুজন পুরুষ, দুজন মহিলা। চার জনের ভেতর শুধু ড. ইলাককে সে আগে দেখেছে, অন্যদের এই প্রথমবার দেখছে। চার জন মানুষ পুরোপুরি ভিন্ন মানুষ, কিন্তু তবু তাদের ভেতরে একটি মিল রয়েছে, মিলটি কী সে ঠিক বুঝতে পারছে না।
কঠিন চেহারার একজন মহিলা কেশে গলা পরিষ্কার করে বলল, ক্লোন তিন শ নয়-
নায়ীরা বাধা দিয়ে বলল, আমার নাম নায়ীরা।
মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, আমাকে কথা শেষ করতে দাও। কিছুক্ষণ নায়ীরার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে মহিলাটি একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে কেন এখানে আনা হয়েছে এবং তোমাকে কী দায়িত্ব দেওয়া হবে সে বিষয়টি তোমাকে জানানোর জন্য এখানে আমরা একত্র হয়েছি। আমরা চার জন ভিন্ন ভিন্ন দপ্তরের। আমি বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান রুবা। এ ছাড়াও এখানে আছেন সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান এবং নিরাপত্তা বাহিনীর মহাপরিচালক জিনা। চিকিৎসা কেন্দ্রের ড. ইলাককে তুমি আগেই দেখেছ। যাই হোক, তুমি নিশ্চয়ই টেহলিস শহঁরের নাম শুনেছ। টেহলিস শহর আমাদের সভ্যতার কেন্দ্রভূমি। আমাদের শিল্প সাহিত্য বিজ্ঞান বা গবেষণা সব টেলিস শহরকেন্দ্রিক। টেলিস শহর এখান থেকে মাত্র দেড় হাজার কিলোমিটার দূরে। কিন্তু তবু সেটি আমাদের থেকে অনেক দূরে। কারণ টেহলিস শহর আর আমাদের মাঝখানে রয়েছে অবমানবের বসতি।
বিজ্ঞান কেন্দ্রের প্রধান কঠিন চেহারার মহিলা রুবা একটি লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বলল, তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের নাম শুনেছ। তারা একসময় চেষ্টা করেছিল পরামানব হতে। মানুষের বিবর্তনকে দ্রুততর করে তারা এমন কিছু ক্ষমতা অর্জন গ্রতে চেয়েছিল, যেটি প্রকৃতি তাদের দিতে রাজি হয় নি। ভয়ংকর সেই পরীক্ষার ফল তারা দিয়েছে নিজেদের পুরো জীবন দিয়ে। তারা বিকলাঙ্গ, অপুষ্ট, অপরিণতবুদ্ধির জটিল একটা প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তারা অতিমানব বা পরামানব হয় নি। তারা হয়েছে অবমানব। অবমানবের বিভিন্ন রূপ সম্ভবত তোমার একবার দেখা উচিত।
নায়ীরা বলল, আমি দেখেছি।
রুবা একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি কোথায় দেখেছ?
আমার ঘরে একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে। সেটা মূল তথ্যকেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত। আমি সেখানে দেখেছি।
হাসিখুশি চেহারার একজন মানুষ, যে সম্ভবত সামরিক বাহিনীর কমান্ডার গ্রুশান, হালকা গলায় বলল, চমৎকার। তা হলে আমাদের কাজ অনেক সহজ হয়ে গেল। তুমি নিশ্চয়ই অবমানবের সঙ্গে আমাদের বিরোধের বিষয়টি জান।
হ্যাঁ জানি।
একজন মানুষ যত বড় হয় তত বেশি সে উদারতা দেখাতে পারে। অবমান বড় হতে পারে নি। তাদের ভেতরে উদারতা বা ভালবাসার মতো বড় কোনো গুণ নেই। তাদের সমস্ত শক্তি সমস্ত ক্ষমতা একত্র করেছে আমাদের ধ্বংস করার জন্য। কমান্ডার শান নামের হাসিখুশি মানুষটিকে হঠাৎ কেমন যেন বিষণ্ণ দেখায়, অবমানবরা আমাদের সমান নয়। কোনো দিক দিয়েই আমাদের সমান নয়, কিন্তু তারপরও আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হয়। আমাদের সীমান্তে সব সময় সশস্ত্র সেনাবাহিনী। আমাদের অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হয় এবং সবচেয়ে দুঃখের কথা, আমরা আমাদের প্রিয় শহর টেলিসে যেতে পারি না। অবমানব আমাদের যেতে দেয় না। যদি কখনো যেতে হয় আমাদের আমরা যাই ভয়ংকর ঝুঁকি নিয়ে।