তিশিনা ফিসফিস করে বলল, তোমরা ক্লোন হও আর যা-ই হও, আসলে তো তোমরা মানুষ। একটি কথা জান নায়ীরা?
কী কথা?
যে মহিলার ক্রোমোজম ব্যবহার করে তোমাদের ক্লোন করা হয়েছে সেই মহিলাটি ছিলেন অসম্ভব রূপসী, অসম্ভব বুদ্ধিমতী এবং অসম্ভব তেজস্বী। তার ভেতরে এমন একটি সহজাত নেতৃত্ব ছিল যে, প্রয়োজনে তার চারপাশের সবাই সব সময় তার নেতৃত্ব মেনে নিত। তিনি একজন অসাধারণ মহিলা ছিলেন।
নায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, আমি শুনেছি।
তিনি এখন কোথায় আছেন জানি না। তিনি যদি তোমাদের দেখতে পেতেন তা হলে খুব কষ্ট পেতেন। তার মতো একজনের জীবনে অনেক বড় কিছু করার কথা। ক্লোন হয়ে গবেষণা কেন্দ্রে গিনিপিগ হওয়ার কথা নয়।
নায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, সেই অসাধারণ মহিলার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ তিশিনা। কারণ তার নিশ্চয়ই অনেক ধৈর্যও ছিল, আমাদেরও অনেক ধৈর্য। আমরা সবকিছু মেনে নিয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারি।
তিশিনা খপ করে নায়ীরার হাত ধরে জ্বলজ্বলে চোখে বলল, আমি কী চাই জান?
কী?
আমি চাই তোমাকে যখন টেহলিস শহরে পাঠাবে তখন সেই অভিযানে একটা বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটুক।
নায়ীরা চোখ বড় করে বলল, সে কী!
হ্যাঁ। সেই দুর্ঘটনায় সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাক। তখন তুমি সেখানে নেতৃত্ব দাও, নেতৃত্ব দিয়ে সবকিছু ঠিক করে দাও। বিজ্ঞান কেন্দ্রের সবাই সেটা দেখুক। দেখে হতবাক হয়ে যাক।
নায়ীরা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন ঘরের ভেতর থেকে একজন বের হয়ে এসে বলে, ক্লোন তিন শ নয়, চেকআপ করতে এস।
নায়ীরা একটা নিশ্বাস ফেলে। এখানে তার পরিচয় ক্লোন তিন শ নয় হিসেবে সে তিশিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বিদায় তিশিনা।
তিশিনা ফিসফিস করে বলল, আমি তোমার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করব। সব সময় প্রার্থনা করব।
নায়ীরা মাথা ঘুরিয়ে ঘরের ভেতরে তাকাল, পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে বলল, আমি প্রস্তুত। কোথায় যেতে হবে?
আমার সঙ্গে এস।
তিশিনা দরজার কাছে পাড়িয়ে থেকে দেখল, নায়ীরা ধীর এবং অনিশ্চিত পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছে। গোলাকার একটা দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল, বিজ্ঞান কেন্দ্রের মানুষটির পিছু পিছু নায়ীরা এগিয়ে যায়, দরজাটি আবার বন্ধ হয়ে গেল। তিশিনা তার বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে নিচু গলায় বলল, হে ঈশ্বর, তুমি এই মেয়েটিকে দয়া করো। সে বড় দুঃখী। দোহাই তোমার।
.
স্বচ্ছ স্ফটিকের মতো বড় টেবিলে নায়ীরা শুয়ে আছে, তার ওপর একজন বয়স্ক মানুষ ঝুঁকে পড়ে তাকে পরীক্ষা করছে। তার কাছাকাছি আরো দুইজন মানুষ। একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। বয়স্ক মানুষটি জিব দিয়ে একটা বিস্ময়ের শব্দ করে বলল, এই মেয়েটির দেহ আশ্চর্য রকম নিখুঁত।
মহিলাটি শব্দ করে হেসে বলল, ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হলে তুমিও এরকম নিখুঁত হতে ড. ইলাক।
ড. ইলাক নামের বয়স্ক মানুষটি মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, সেটা তুমি ঠিকই বলেছ।
মহিলাটি বলল, আমার মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লোন হিসেবে এরকম নিখুঁত একজন মানব কিংবা মানবী তৈরি করা এক ধরনের অপচয়।
ড. ইলাক বলল, আমরা যে কাজে একে ব্যবহার করব তার জন্য একটি নিখুঁত দেহ দরকার।
নায়ীরা নিঃশব্দে তাদের কথোপকথন শুনছিল, সে সত্যিকারের মানুষ নয়, তার হয়তো নিজে থেকে কোনো কথা বলার নয়, কিন্তু সে তবুও কথা বলল। জিজ্ঞেস করল, আমাকে তোমরা কী কাজে ব্যবহার করবে?
এক মুহূর্তের জন্য ঘরের তিন জন মানুষ একটু থমকে দাঁড়াল। মনে হল তারা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেছে। ড. ইলাক ইতস্তত করে বলল, তোমার এখন সেটি জানার কথা নয় মেয়ে।
আমার নাম নায়ীরা।
মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তোমার কোনো নামও থাকার কথা নয়।
নায়ীরা একটু চেষ্টা করে তার মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলল, কিন্তু আমার নাম আছে। আমার মনে হয় নায়ীরা খুব সুন্দর একটি নাম।
ড. ইলাক বলল, নায়ীরা নামটি সুন্দর না অসুন্দর সেটি নিয়ে আলোচনা করার কোনো অর্থ নেই। বিষয়টি তোমাকে নিয়ে। তোমার নিজে থেকে প্রশ্ন করার কথা নয়।
ড. ইলাকের কথা শুনে নায়ীরা শব্দ করে হাসল। ড. ইলাক থতমত খেয়ে বলল, তুমি হাসছ কেন?
তোমার কথা শুনে।
আমার কোন কথাটি হাস্যকর?
নায়ীরা মুখ টিপে হেসে বলল, আমার নিজ থেকে কোনো প্রশ্ন করার কথা নয় সেটি আমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়।
ড. ইলাক অবাক হয়ে বলল, কেন? কেন কথাটি তোমার কাছে কৌতুকের মতো মনে হয়? তুমি মানুষ নও, তুমি একটি ক্লোন।
কিন্তু আমি এমন একটি মানুষের ক্লোন, যার বুদ্ধিমত্তা সম্ভবত তোমাদের সবার থেকে বেশি। যার প্রতিভা নিশ্চিতভাবে তোমাদের প্রতিভার চেয়ে বেশি।
নায়ীরার কথা শুনে উপস্থিত তিন জন মানুষই কেমন যেন থতমত হয়ে যায়। মহিলাটি খনখনে গলায় বলল, তুমি কেমন করে সেটা জান?
আমি আরো অনেক কিছু জানি। হয়তো সবকিছু আমার জানার কথা নয়, তবু আমি জানি। একজন মানুষ জোর করে নির্বোধ হয়ে থাকতে পারে না।
মহিলাটি খনখনে গলায় আবার কোনো একটা কথা বলতে শুরু করতে চাইছিল কিন্তু ড. ইলাক হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, কে বেশি প্রতিভাবান, কে বেশি বুদ্ধিমতী এসব আলোচনা থাকুক। তোমাকে একটা বিশেষ কাজে আনা হয়েছে, সেই কাজের জন্য তোমাকে যেটুকু জানানোর প্রয়োজন হবে তোমাকে যেটুকু জানানো হবে মেয়ে।