তিশিনা কয়েক মুহূর্ত মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে যাবে সেটা কি ঠিক করেছ?
মেয়েগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকাল। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি নিচু গলায় বলল, আসলে আমাদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের কোনো পার্থক্য নেই। তাই যে কোনো একজন তোমার সঙ্গে যাবে।
কিন্তু সেটি কে?
সেটি আমরা একেবারে শেষ মুহূর্তে ঠিক করব তিশিনা।
এক পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে বলল, তোমার যেন সময় নষ্ট না হয় সেজন্য আমরা সবাই পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে আছি।
সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের ব্যাগটিও প্রস্তুত করে রেখেছি। তুমি ডাকলেই আমাদের একজন এসে ব্যাগটি তুলে নিয়ে তোমার সঙ্গে বের হয়ে যাবে।
তিশিনা কোমল গলায় বলল, আমি বুঝতে পারছি, মেয়েরা। আমি তোমাদের সঙ্গে থাকলে মনে হয় এটাই করতাম।
আমাদের সবাই একরকম, সবাই একসঙ্গে থাকি, একভাবে কথা বলি, একতাবে ভাবি। এত দিন এভাবে আছি যে, এখন মনে হয় আমরা সবাই মিলে বুঝি একজন মানুষ।
তাই আমাদের একজন যখন আমাদের ছেড়ে চলে যায় তখন আমাদের খুব কষ্ট হয়। আমরা কষ্টের মুহূর্তটাকে যতদূর সম্ভব বিলম্বিত করতে চাই।
তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, আমি বুঝতে পারছি।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, যে তোমার সঙ্গে যাবে তার জীবনটি হবে অন্যরকম।
নিশ্চয়ই তার জীবনটি হবে সুন্দর। সুন্দর এবং উত্তেজনাময়।
একেবারে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমরা তাকে স্পর্শ করে রাখতে চাই তিশিনা।
তিশিনা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই শেষ মুহূর্তটা এসে গেছে। তোমাদের একজন এখন এস আমার সঙ্গে।
মেয়েগুলো তখন হাত তুলে একজন আরেকজনকে শক্ত করে ধরে ধরে চোখ বন্ধ করল, তাদের দেখে মনে হয় তারা বুঝি উপাসনা করছে। ঠিক কীভাবে তারা ঠিক করল তিশিনা বুঝতে পারল না। কিন্তু হঠাৎ মাঝামাঝি জায়গা থেকে একজন এগিয়ে এসে তিশিনার সামনে দাঁড়িয়ে বলল, চল তিশিনা।
তুমি যাবে?
হ্যাঁ। মেয়েটি ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে বলল, আমি প্রস্তুত।
তিশিনা ভেবেছিল মেয়েটি হয়তো অন্য মেয়েগুলোর কাছ থেকে বিদায় নেবে, কিন্তু সেরকম কিছু করল না। এরা একজনের সঙ্গে আরেকজন মুখে কোনো কথা না বলেই অনেক কিছু বলে দিতে পারে, নিশ্চয়ই সেরকম কিছু একটা হয়েছে। সম্ভবত সেভাবেই সে বিদায় নিয়েছে।
অন্য দশজন মেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল, সামনের মেয়েটি বলল, আমাদের কখনো কোনো নামের প্রয়োজন হয় না, কারণ আমরা সবাই মিলে আসলে একজন মানুষ। কিন্তু যখন কাউকে চলে যেতে হয় তখন তার একটা নামের প্রয়োজন হয়।
অন্য পাশ থেকে আরেকটি মেয়ে বলল, আমরা তাই অনেক ভেবে একটা নাম ঠিক করেছি। নায়ীরা।
নায়ীরা, তোমার সঙ্গে অনেক মানুষের পরিচয় হবে। তারা হবে সুন্দর মনের মানুষ। তাদের ভালবাসা পাবে তুমি।
সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল তোমার সঙ্গে রাজপুত্রের মতো কোনো এক সুদর্শন তরুণের পরিচয় হবে। সেই রাজপুত্রের মতো সুদর্শন তরুণের হৃদয়ে থাকবে ভালবাসা। তার ভালবাসায় তোমার জীবন পরিপূর্ণ হবে।
পাশের মেয়েটি বলল, নায়ীরা, তোমার সঙ্গে সম্ভবত আমাদের আর যোগাযোগ হবে না। আমরা সবকিছু কল্পনা করে নেব। তোমার জীবনে আনন্দের কী ঘটছে, উত্তেজনার কী ঘটছে, ভালবাসার কী ঘটছে আমরা সেগুলো কল্পনা করে নেব।
তার পাশের মেয়েটি বলল, আমরা বিদায় কথাটি উচ্চারণ করব না। কারণ আমরা তোমাকে বিদায় দিচ্ছি না। তুমি আমাদের সঙ্গেই আছ। তুমি আমাদের মাঝখানেই আহ নায়ীরা।
সামনের মেয়েটি বলল, আমরাও তোমার মাঝেই থাকব। আমাদের সবাইকে তুমি তোমার মাঝে পাবে। সব সময় পাবে।
নায়ীরা ফিসফিস করে বলল, আমি জানি। তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখ দুটো মুছে তিশিনার দিকে তাকাল। তিশিনা তার হাত ধরে বলল, চল, নায়ীরা।
ঘড়ঘড় শব্দ করে পেছনের দরজাটা বন্ধ হয়ে যেতেই নায়ীরা দুই হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। তিশিনা নায়ীরার পিঠে হাত রেখে বলল, মন খারাপ করো না নায়ীরা, দেখো, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।
আসলে কিছুই ঠিক হবে না, কিন্তু তিশিনার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করল যে সত্যিই বুঝি সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। নায়ীরা কোনো কথা বলল না, হেঁটে যেতে যেতে একবার পেছন ফিরে তাকাল। গোপন ল্যাবরেটরির ভারী দরজার ওপাশে যাদের সে ফেলে এসেছে তারা ভিন্ন কোনো মানুষ নয়, তারা সবাই সে নিজে। একজন মানুষকে যখন নিজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতে হয় সেই কষ্টটার কথা অন্য কেউ জানে না। পৃথিবীর অন্য কেউ কোনো দিন সেটা বুঝতেও পারবে না।
.
বিজ্ঞান কেন্দ্রের ভেতরে ক্লোন গবেষণা বিভাগের দরজায় দাঁড়িয়ে তিশিনা নায়ীরার হাত স্পর্শ করে বলল, আমাকে এখন যেতে হবে নায়ীরা।
নায়ীরা নিচু গলায় বলল, আমি জানি।
তোমার জন্য অনেক শুভকামনা থাকল।
তোমাকে ধন্যবাদ। আমাদের জন্য তুমি যেটুকু করেছ সেজন্য অনেক ধন্যবাদ।
আমি তোমাদের জন্য কিছু করি নি নায়ীরা।
নায়ীরা ম্লান হেসে বলল, করেছ, তিশিনা। আমরা আসলে মানুষ নই, আমরা মানুষের ক্লোন। কিন্তু তুমি কখনো সেটা আমাদের বুঝতে দাও নি। তুমি সব সময় আমাদের মানুষ হিসেবে সম্মান দেখিয়েছ, মানুষ হিসেবে ভালবেসেছ।