কী মনে হয়?
মেয়েটি মুখে হাসিটি ধরে রেখে বলল, আমার মনে হয়, এটি আমাদের খুব বড় সৌভাগ্য।
তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, হ্যাঁ, অনেক বড় সৌভাগ্য।
একজন একজন করে আমরা সবাই বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছি।
বিজ্ঞান কেন্দ্রে নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। তাই না?
হ্যাঁ। প্রথম মেয়েটি মাথা নেড়ে বলল, নিশ্চয়ই খুব মজা হয়। কত রকম মানুষের সঙ্গে দেখা হয়।
বাইরের মানুষেরা খুব ভালো, তাই না তিশিনা?
তিশিনা কী বলবে বুঝতে না পেরে অনিশ্চিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। মেয়েটি উজ্জ্বল চোখে বলল, আমাদের এখানেও আমাদের খুব সুন্দর একটা জীবন। সবাই মিলে খুব আনন্দে থাকি। যখন আমরা বাইরে যাই, তখন আমাদের আনন্দের সঙ্গে যোগ হয় উত্তেজনা।
সবগুলো মেয়ে মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। উত্তেজনা, সত্যিকারের উত্তেজনা।
তিশিনা এক ধরনের গভীর বেদনা নিয়ে মেয়েগুলোর দিকে তাকিয়ে রইল। এই মেয়েগুলো অসম্ভব বুদ্ধিমতী, সত্যিকার ব্যাপারটি তারা বুঝতে পারে না তা নয়, সেটা তারা প্রকাশ করে না। অনেকটা জোর করে এই নিষ্ঠুর বিষয়টির মধ্যে আনন্দ খুঁজে বের করার ভান করে। একটি মেয়ে তিশিনার হাত ধরে বলল, তিশিনা, তুমি কি জান, বিজ্ঞান কেন্দ্রে আমাদের কী করতে দেবে?
তিশিনা মাথা নাড়ল, বলল, না, জানি না। তবে
তবে কী?
চিঠিতে লেখা আছে আমি যেন সুস্থ, সবল, নীরোগ একজনকে বেছে নিই।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কেন তিশিনা?
কারণ তাকে টেহলিস শহরে যেতে হবে।
মেয়েগুলো এবারে বিস্ময়ের একটি শব্দ করল, বলল, সত্যি? সত্যি টেহলিস শহরে যেতে হবে?
হ্যাঁ। টেহলিস শহর অনেক দূরে। এখন সেখানে যাওয়া খুব কঠিন।
আমাদেরকে এরকম কঠিন একটা অভিযানে নেবে?
হ্যাঁ। তিশিনা মাথা নাড়ল, তোমাদের একজনকে সেখানে যেতে হবে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমি বলেছিলাম না, পুরো বিষয়টাই উত্তেজনার। মেয়েটা তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ, চিন্তা করেই আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠছে।
তিশিনা মেয়েটার হাত স্পর্শ করে বলল, বিজ্ঞান কেন্দ্র আমাকে খুব বেশি সময় দেয় নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমার একজনকে বেছে নিতে হবে।
মাত্র চব্বিশ ঘণ্টা?
হ্যাঁ তিশিনা এক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তোমাদের মধ্যে কে যেতে চাও?
মেয়েগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। সবাই দেখতে যেমন হুবহ এক, তাদের চিন্তাভাবনাও ঠিক একই রকম। জন্মের পর থেকে তারা পাশাপাশি বড় হয়েছে, এখন তারা এমন একটা পর্যায়ে এসে গেছে যে, একজন আরেকজনের চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝে ফেলতে পারে কে কী ভাবছে। একজন নরম গলায় বলল, তিশিনা, তুমি আমাদের জন্য এরকম চমৎকার একটা সুযোগ নিয়ে এসেছ, সেজন্য তোমার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা সবাই টেহলিস শহরে যেতে চাই। কিন্তু বিজ্ঞান কেন্দ্র তো মাত্র একজনকে চেয়েছে।
তিশিনা মাথা নাড়ল, হ্যাঁ। একজনকে চেয়েছে।
মেয়েটি বলল, তোমার যদি কোনো আপত্তি না থাকে তা হলে আমরা কি সেটা নিজেদের মধ্যে কথা বলে ঠিক করতে পারি?
হ্যাঁ। পার।
তা হলে খুব ভালো হয়, তিশিনা। আগামীকাল তুমি যখন আমাদের একজনকে নিতে আসবে আমরা একজন তখন তোমার জন্য প্রস্তুত হয়ে থাকব।
চমৎকার। তিশিনা একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মেয়েরা, আমি কি এখন যেতে পারি? বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার আগে আমার কিছু আনুষ্ঠানিক কাজ করতে হয়।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, আমরা ভেবেছিলাম তুমি আজ আমাদের সঙ্গে অনেকক্ষণ থাকবে তিশিনা?
নিশ্চয়ই থাকব একদিন। আজ নয়। ঠিক আছে?
মেয়েগুলো মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। তিশিনা করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করে, মেয়েগুলো আজকে আর অন্যদিনের মতো তার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে এল না। তিশিনাও আজ পেছন ফিরে তাকাল না। সেও জানে, আজ পেছন ফিরে তাকালে দেখতে পাবে ফুটফুটে মেয়েগুলো মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে, চোখেমুখে কী গভীর বিষাদের ছায়া!
৩. বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি
বিজ্ঞান কেন্দ্রে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে নিতে দীর্ঘ সময় লেগে গেল। এই মেয়েগুলো একটা গোপন প্রজেক্ট, তাদের সম্পর্কে কোথাও কোনো তথ্য নেই। নিরাপত্তাকর্মীরা যেন কোন সমস্যা না করে সেজন্য বিশেষ অনুমতিপত্রের ব্যবস্থা করতে হল। গোপন ল্যাবরেটরির চার দেয়ালের ভেতরে থাকে বলে মেয়েগুলোর বাইরের জীবন সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই জরুরি কাজে লাগতে পারে সেরকম কিছু জিনিসপত্র একটা ব্যাগে গুছিয়ে নিতে হল। পুরো ব্যাপারটি গোপন তাই তার নিজেকেই একটা গাড়ি করে নিয়ে যেতে হবে, গাড়ির জ্বালানি, নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার অনুমতি নেটওয়ার্ক থেকে ডাউনলোড করে নিতে হল। ঠিক কী কাজে এই মেয়েটিকে ব্যবহার করবে জানা নেই, তাই তিশিনা মেয়েটির সকল তথ্য একটা ক্রিস্টালে জমা করে নিল।
পরদিন তিশিনা আবার যখন ল্যাবরেটরির ভারী দরজা খুলে ভেতরে ঢুকেছে তখন করিডরে সব কয়টি মেয়ে প্রায় জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে আছে। মেয়েগুলো সুন্দর করে। সেজেছে, চুলগুলো পরিপাটি করে বাধা। তাদের জামাকাপড় খুব বেশি নেই, তার মাঝে সবচেয়ে ভালো পোশাকটি তারা পরেছে। দরজার কাছাকাছি একটা ব্যাগ। সেখানে হয়তো দৈনন্দিন প্রয়োজনের জিনিসগুলো রেখেছে।