আমরা মাথা নাড়লাম, না।
তোমাদের এই পাঁচ জনকে আমি এখানে কেন এনেছি জান?
আমরা কেউ কোনো কথা বললাম না। ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, তোমাদের জানার কথা নয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত তবু তোমরা জান। কারণ তোমরা কেউ সাধারণ মানুষ নও। তোমরা প্রত্যেকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রতিভাবান, সবচেয়ে বুদ্ধিমান মানুষদের একজন। ঈশ্বর সম্ভবত নিজের হাতে তোমাদের মস্তিষ্কের নিউরোন সেলগুলো একটি একটি করে সাজিয়েছেন। তোমাদের মস্তিষ্কের যে ক্ষমতা–একজন মানুষের মস্তিষ্ক কেমন করে সেরকম ক্ষমতাশালী হতে পারে সেটা একটা রহস্য।
ইয়োরন রিসি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, তোমরা নিজেরা জান যে তোমরা সাধারণ মানুষ নও। তোমাদের প্রত্যেকে অসাধারণ ক্ষমতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেছ কিন্তু তোমরা সেটা প্রাণপণে সবার কাছে গোপন করে রাখ। শুধু যে অন্যদের কাছে গোপন রাখ। তাই নয়, অনেক সময় তোমরা তোমাদের নিজেদের কাছে পর্যন্ত গোপন করে রাখ। কেন সেটা কর আমাদের কাছে, বিজ্ঞান পরিষদের কাছে তা একটা মস্ত বড় রহস্য। ইচ্ছে করলেই তোমরা পৃথিবীর যত সম্পদ, যত সম্মান, ভালবাসা, খ্যাতি, প্রতিপত্তি সবকিছু পেতে। পার। কিন্তু তোমরা সেটা চাও না। হিশান একটা ব্যাংকে কষ্ট করে কাজ কর, ইগা জেলে যাবার ঝুঁকি নিয়ে নেশার ওষুধ তৈরি কর, নুবা একটা স্কুলে পড়াও, য়োমি খবরের কাগজের অফিসে খ্যাপা মানুষদের অভিযোগ শুনে সময় কাটাও, রিকি ভালবাসার মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যেতে দাও। কেন এটা কর আমরা কেউ জানি না। মনে হয় কোনোদিন জানবও না। মানুষের মন খুব বিচিত্র একে কেউ বোঝে না। আমরা তাই তোমাদের কখনো বিরক্ত করি নি। তোমাদের একটু চোখে চোখে রেখেছি, একটু আগলে রেখেছি কিন্তু কখনোই তোমাদের স্বাধীন জীবনে হাত দিই নি। কখনো না।
ইয়োরন রিসি একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, ভেবেছিলাম কখনো দেব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পারলাম না। তোমাদের মতো মানুষদের একটা ছোট লিস্ট আছে আমার কাছে। সেখান থেকে বেছে বেছে আমি তোমাদের পাঁচ জনকে আজ এখানে ডেকে এনেছি। কেন ডেনে এনেছি জান?
হিশান তার লম্বা চুলে হাত ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমাদের একটা সমস্যা সমাধান করতে হবে?
ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন– হ্যাঁ। কী সমস্যা বলতে পারবে?
ইগা বলল, কঠিন কোনো সমস্যা? যার সাথে
যার সাথে?
যার সাথে পৃথিবীর অস্তিত্ব জড়িত?
হ্যাঁ। হঠাৎ করে ইয়োরন রিসির মুখ কেমন জানি বিষণ্ন হয়ে যায়। আস্তে আস্তে বললেন, পৃথিবীর খুব বিপদ। খুব বড় বিপদ।
তিনি হঠাৎ ঘুরে নুবার দিকে তাকিয়ে বললেন, নুবা তুমি বলতে পারবে কী বিপদ?
আমি?
হ্যাঁ।
আমাকে যখন জিজ্ঞেস করছেন তার মানে এর সাথে ঐতিহাসিক কোনো ঘটনার যোগাযোগ আছে।
ইয়োরন রিসি কোনো কথা বললেন না, আমি দেখতে পেলাম হঠাৎ করে নুবার মুখ রক্তশূন্য হয়ে গেল। সে কাঁপা গলায় বলল, শ্যালন গ্রুন ফিরে এসেছে?
ইয়োরন রিসি অত্যন্ত বিষণ্ণ ভঙ্গিতে হাসলেন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, হ্যাঁ নুবা। আমাদের খুব দুর্ভাগ্য শ্যালক্স গ্রুন গত সপ্তাহে পৃথিবীতে অবতরণ করেছে।
আমি হঠাৎ আতঙ্কের একটা শীতল স্রোতকে মেরুদণ্ড দিয়ে বয়ে যেতে অনুভব করলাম।
০৩. শৈশবে যখন অনাথ আশ্রমে
শৈশবে আমি যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম তখন রাত্রিবেলা আমরা ঘুমাতে দেরি করলে আমাদের শ্যালক্স গ্রুনের ভয় দেখানো হত। শ্যালক্স গ্রুন মানুষটা কে, কেন তার নাম শুনে আমাদের ভয় পেতে হবে আমরা তার কিছুই জানতাম না। কিন্তু সত্যি সত্যি ভয়ে আমাদের হাতপা ঠাণ্ডা হয়ে যেত। একটু বড় হয়ে শ্যালক্স গ্রুনের সত্যিকার পরিচয় জেনেছি। অসাধারণ প্রতিভাবান এবং সম্পূর্ণ ভালবাসাহীন একজন মানুষ। কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে পৃথিবীর যা–কিছু সুন্দর তার সবকিছুতে মানুষটির এক ভয়ঙ্কর একরোখা আক্রোশ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে সে এক ধরনের ভাইরাস বের করেছে যার বিরুদ্ধে মানুষের কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা নেই। ভাইরাসটির নাম লিটুমিনা–৭২, বাতাসে ভেসে সেটি ছড়িয়ে পড়তে পারে, বিজ্ঞানীদের ধারণা ছোট একটা কাঁচের এল ভরা মানুষের রক্তে যে পরিমাণ লিটুমিনা–৭২ নেয়া সম্ভব সেটা দিয়ে পৃথিবীর সব মানুষকে একাধিকবার মেরে ফেলা যায়। বাতাস কোনদিকে বইছে তার ওপর নির্ভর করবে কতটুকু সময়ে পুরো পৃথিবী প্রাণহীন হয়ে যাবে। শ্যালক্স গ্রুনের এই ভাইরাসটির প্রতি গভীর মমতা ছিল। একদিন সে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকেন্দ্রের গোপন ভল্ট থেকে এই ভাইরাসের নমুনার বোতলটি নিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল। যাবার আগে সে বলে গিয়েছিল পৃথিবীর ওপরে সে পুরোপুরি বীতশ্রদ্ধ হয়ে গেছে–তাকে নিজের হাতে ধ্বংস করা থেকে বেশি আনন্দ আর কিছুতে সে পাবে না। সে ইচ্ছে করলেই এই আনন্দ পেতে পারে, তার কাছে যথেষ্ট লিটুমিনা–৭২ রয়েছে, কিন্তু এই পৃথিবী এত নিচু স্তরে রয়ে গেছে যে সেটিকে ধ্বংস করায় কোনো আনন্দ নেই। তাই সে ভবিষ্যতে পাড়ি দিচ্ছে, হয়তো পৃথিবী খানিকটা উন্নত হবে, তখন সেটাকে ধ্বংস করা মোটামুটি একটা আনন্দের ব্যাপার হতে পারে।
পৃথিবীর মানুষ তারপর আর কখনো শ্যালক্স গ্রুনকে দেখে নি। সত্যি সত্যি সে ভবিষ্যতে পাড়ি দিয়েছে সেটি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাপার নয়। গবেষণাগারে ছোটখাটো জিনিসকে সময় পরিভ্রমণ করে কিছু দূরত্ব নেয়া যায়, কিন্তু তাই বলে সত্যিকারের একজন মানুষ কোনো এক ধরনের সময়–পরিভ্রমণ–যানে সুদূর ভবিষ্যতে চলে যাবে সেটি সে–সময়ের বিজ্ঞান বা প্রযুক্তিতে কিছুতেই সম্ভব হওয়ার কথা ছিল না। কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন সেই অসম্ভব ব্যাপারটিকে সম্ভব করেছিল, ঠিক কীভাবে করেছিল সেটাও একটি রহস্য।