ঠিক এই সময় নিঃশব্দে একটা দরজা খুলে গেল এবং বুড়োমতো একজন ছোটখাটো মানুষ হাতে ছোট একটা প্যাকেট নিয়ে ঘরে ঢুকল। মানুষটি ছোট ছোট পায়ে হেঁটে আমাদের কাছে এগিয়ে এল এবং আমরা হঠাৎ করে তাকে চিনতে পারলাম, ইয়োরন রিসি! কতবার হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে এই মানুষটির ছবি দেখেছি কিন্তু কখনোই ভাবি নি তিনি এ রকম ছোটখাটো মানুষ। কেন জানি না ধারণা ছিল তিনি হবেন বিশাল, তার চেহারা হবে কান্তিময়, গায়ের রং হবে উজ্জ্বল, তার পোশাক হবে বর্ণময়–কিন্তু তিনি একেবারে সাধারণ চেহারার মানুষ। কিন্তু তাকে দেখে আমার আশাভঙ্গ হল না বরং বুকের ভিতরে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করতে থাকি। আমার এক ধরনের অবিশ্বাস্য রোমাঞ্চ হতে থাকে।
ইয়োরন রিসি টেবিলের কাছে এসে থেমে আমাদের সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, সে কী! তোমরা সবাই এত দূরে দূরে বসেছ কেন? এস কাছাকাছি এস। এখানে এত বড় একটা টেবিল রাখাই ভুল হয়েছে।
আমি তাড়াতাড়ি উঠতে গিয়ে হাঁটুতে একটা চোট পেলাম। সে অবস্থাতেই তার যতটুকু কাছে গিয়ে বসা সম্ভব সেখানে বসে গেলাম। এই মানুষটির পাশে বসা দূরে থাকুক কোনোদিন নিজের চোখে দেখব ভাবি নি।
ইয়োরন রিসি আমাদের দিকে তাকালেন। তার মুখে এক ধরনের হাসি, দুষ্ট ছেলের দুষ্টুমি ধরে ফেলে সহৃদয় বাবারা যেভাবে হাসে অনেকটা সেরকম। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ আমি ইয়োরন রিসি। তোমরা কারা পরিচয় দিতে হবে না, আমি তোমাদের সবাইকে খুব ভালো করে চিনি।
আমরা পাঁচ জন অবাক হয়ে একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। আমাদের বিস্ময়টুকু মনে হয় তিনি খুব উপভোগ করলেন, হা হা করে হেসে বললেন, বিশ্বাস হচ্ছে না তোমাদের? এই দেখ আমি ঠিক বলি কি না—
ইয়োরন রিসি দাড়িগোঁফে ঢাকা জঙ্গুলে চেহারার মানুষটিকে দেখিয়ে বললেন, তুমি হিশান। তুমি একটা ব্যাংকে চাকরি কর। ছোট্ট চাকরি, তোমার কাজে মন নেই। উপরওয়ালা দুদিন পরে পরে তোমাকে হুমকি দিয়ে বলে তোমাকে ছাঁটাই করে দেবে। শীতের শুরুতে তুমি দাড়িগোঁফ রাখা শুরু কর, বসন্তের শেষে যখন একটু গরম পড়তে শুরু করে তখন তুমি দাড়িগোঁফ চুল কামিয়ে পুরোপুরি ন্যাড়া হয়ে যাও। ঠিক কি না, হিশান?।
হিশান নামের মানুষটি হেসে ফেলল। দাড়িগোঁফে আড়াল হয়ে থাকা মুখ থেকে সহৃদয় হাসিটি বের হতেই আমরা হঠাৎ করে টের পেলাম মানুষটিকে দেখে তিরিক্ষে বদমেজাজি মনে হলেও সে নেহাতই ভালো মানুষ।
ইয়োরন রিসি এবারে ছিমছাম পরিষ্কার মানুষটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি ইগা। তোমার একটা গোপন ল্যাবরেটরি আছে সেখানে তুমি বিসুবিচারিয়াস বানাও। খোলাবাজারে মোটামুটি ভালো দামে বিক্রি হয়, এত মজার নেশা আর কি আছে?
ইগার মুখ হঠাৎ ফ্যাকাশে হয়ে যায়। ইয়োরন্ রিসি হা হা করে হেসে তার প্যাকেটটা তুলে বললেন, তুমি ভাবছ কেউ জানে না? এই দেখ আমার কাছে তোমার কত বড় ফাইল!
ইগা নামের মানুষটি কী একটা কথা বলতে গেল, ইয়োরন রিসি তার কাধ স্পর্শ করে থামিয়ে দিয়ে চোখ মটকে বললেন, তোমার কোনো ভয় নেই ইগা। পুলিশ কোনোদিন তোমাকে ধরবে না। আমি আছি তোমার পিছনে।
ইগা ভয়ে ভয়ে ইয়োরন রিসির দিকে তাকাল, এখনো সে ঠিক বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। বেশ দ্রুত তার মুখ থেকে ভয়ের চিহ্ন কেটে এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। ইয়োরন রিসি এবারে ঘুরে কোমল চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি নুবা। তুমি দক্ষিণের পাহাড়ি অঞ্চলে একটা বাচ্চাদের স্কুলে পড়াও। তোমার প্রিয় বিষয় হচ্ছে ইতিহাস। ছুটির দিনে তুমি হেঁটে হেঁটে একটা ছোট পাহাড়ের চূড়ায় উঠে চুপচাপ আকাশের দিকে তাকিয়ে বসে থাক। তুমি যে গ্রামে থাক সেখানকার সবাই তোমাকে খুব পছন্দ করে, যদিও তাদের অনেকের ধারণা ভালো ওষুধপত্র খেলে তোমার চুপচাপ একা একা বসে থাকার রোগ ভালো হয়ে যাবে।
ইয়োরন রিসির সাথে সাথে আমরাও হেসে উঠলাম। তিনি হাসি থামিয়ে এবার খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকমকে চেহারার মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি য়োমি। একটা খবরের কাগজের অফিসে কাজ কর। অত্যন্ত বিরক্তিকর কাজ, ভিডিও সেন্টারে বসে থাকা, লোকজনের যার যত সমস্যা আছে, অভিযোগ আছে তোমার কাছে বলে। মাঝে মাঝেই কিছু খ্যাপা গোছের মানুষ বের হয়ে যায়–তোমাকে খামখাই যাচ্ছেতাই গালিগালাজ করে। তুমি গত দুই বছর থেকে ভাবছ এই কাজ ছেড়ে দেবে কিন্তু তবু ছাড়ছ না।
ইয়োরন রিসি এবারে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি রিকি। তোমার বন্ধুবান্ধব খুব বেশি নেই। তোমার অনেকদিনের ভালবাসার মেয়েটিও গতকাল তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে। তার ধারণা তোমার জীবন নিয়ে খুব উচ্চাশা নেই। সত্যি কথা বলতে কী তোমার পরিচিতদের সবারই তাই ধারণা। এখানে অন্য চার জন কিছু–না–কিছু কাজ করে, তুমি কিছুই কর না। তোমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু হচ্ছে চার মাত্রার একটা রবোট!
ইয়োরন রিসি আবার হা হা করে হাসলেন এবং অন্য সবাই সেই হাসিতে যোগ দিল। চার মাত্রার একটি রবোটের সাথে একজন মানুষের বন্ধুত্ব হতে পারে সেটা বিশ্বাসযোগ্য কথা নয় ঠাট্টা করে বলা হয়েছে। ইয়োরন রিসি সবার মুখের দিকে একবার তাকিয়ে বললেন, আমি কি কারো সম্পর্কে ভুল কিছু বলেছি?