আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু আমার সাথে?
হ্যাঁ।
যদি আমি কাল বাসায় না থাকতাম? চিঠি যদি না পেতাম?
লোকটা হাত নেড়ে পুরো ব্যাপারটা উড়িয়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, আপনি মনে করছেন মহামান্য রিসি যদি আপনার সাথে দেখা করতে চান তখন সেটা আমরা কখনো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিই? কখনোই দিই না!
আমি–আমি কখনো এত বড় মানুষের সাথে দেখা করি নি। কী করতে হয়, কী বলতে হয় কিছুই জানি না। ভালো কাপড়ও মনে হয় নেই আমার
সাথের মেয়েটি এই প্রথমবার কথা বলল, আপনি যেন সেসব নিয়ে মাথা না ঘামান সে জন্যেই আমরা এখানে এসেছি। মহামান্য রিসি আপনার সাথে দেখা করতে চাইছেন সেটা হচ্ছে বড় কথা! আপনি যেভাবে সহজ বোধ করেন ঠিক সেভাবে থাকবেন। কোনোকিছু নিয়ে এক বিন্দু মাথা ঘামাবেন না।
আর কে কে সেখানে থাকবে?
আমরা তো জানি না। আমাদের জানার কথাও না!
কোনোরকম কি কিছু আভাস দিতে পারেন?
মধ্যবয়স্ক লোকটি এবারে এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বলল, রিকি–আপনি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে সৌভাগ্যবান মানুষদের একজন। ব্যাপারটি কী আমরা জানি না, কিন্তু এটুকু নিশ্চিত জানি আর যাই হোক এটা অশুভ হতে পারে না। আপনি যান, হাতমুখ ধুয়ে আসুন! একসাথে নাশতা করা যাক।
আমি ভিতরে যাচ্ছিলাম, মেয়েটা বলল, একটা মাত্রার রবোট দেখলাম, আপনার রবোট এটা?
হ্যাঁ। কিটি।
কী আশ্চর্য! আমি কখনো সচল চতুর্থ মাত্রার রবোট দেখি নি। আমার ধারণা ছিল সব সরিয়ে নেয়া হয়েছে।
আমি হেসে বললাম, খোঁজ পেলে কিটিকেও সরিয়ে নেবে। আমি খোঁজ দিই নি। অনেকদিন থেকে আছে তাই মায়া পড়ে গেছে।
ও! মেয়েটা মনে হল একটু অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, কোনো তাড়াহুড়া করবেন না। আমরাই আপনাকে বিজ্ঞান পরিষদে নিয়ে যাব।
.
আমরা যখন বিজ্ঞান পরিষদে পৌঁছেছি তখনো বেশ সকাল। দরজায় নানা রকম কড়াকড়ি রয়েছে, সবার রেটিনা স্ক্যান করে ভেতরে ঢুকতে হচ্ছে কিন্তু আমার কিছুই করতে হল না। সাথের দুজন আমাকে ভিতরে নিয়ে এসে অন্য দুজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল, তারা আবার অন্য দুজনের কাছে এবং এই দুজন আমাকে বিশাল একটি হলঘরে নিয়ে হাজির হল। ঘরটির দেয়াল অর্ধস্বচ্ছ এক ধরনের পাথরের তৈরী।
ছাদটি অনেক উঁচুতে, সেখান থেকে হালকা এক ধরনের আলো বের হচ্ছে, সমস্ত ঘরে কোমল এক ধরনের আলো। ঘরে কোনো জানালা নেই, শুধু মাঝখানে বিশাল একটা কালো টেবিল। টেবিলটি ঘিরে রয়েছে খুব সুন্দর অনেকগুলো চেয়ার, সুন্দর চেয়ার সাধারণত আরামদায়ক নয় কিন্তু আমি বসে বুঝতে পারলাম চেয়ারগুলো তৈরি হয়েছে অসম্ভব যত্ন করে, বসতে ভারি আরাম।
ঘরটিতে আমি ছাড়াও আর চার জন মানুষ, দুজন মেয়ে এবং দুজন পুরুষ। সবাই মোটামুটি আমার বয়সী, দেখে মনে হয় আমার সাথে তাদের সবার এক ধরনের মিল রয়েছে, কিন্তু মিলটুকু কোথায় আমি ঠিক ধরতে পারলাম না। দুজন পুরুষ মানুষের মাঝে একজন খুব ছিমছাম পরিষ্কার, মাথার চুল পরিপাটি, কাপড় জামা সুন্দর এবং মোটামুটি রুচিসম্মত। সে আরামদায়ক চেয়ারটিতে হেলান দিয়ে খুব শান্তভাবে বসে আছে। এমনিতে। দেখে বোঝা যায় না কিন্তু তার চোখের দিকে তাকাতেই বোঝা যায় মানুষটি ভিতরে ভিতরে খুব উদ্বিগ্ন।
ঘরের দ্বিতীয় মানুষটির মাথায় লম্বা চুল, মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল। গায়ের জামাকাপড় যাচ্ছেতাই এবং চেহারাতে এক ধরনের বেপরোয়া ভাব। তাকে দেখে মনে হয় কোনো কিছুতেই তার কিছু আসে যায় না। মেয়ে দুজনের একজন কোমল চেহারার, রাস্তায় ছোট শিশুর হাত ধরে যেরকম কমবয়সী মায়েদের হেঁটে যেতে দেখা যায় তার চেহারা অনেকটা সেরকম। মেয়েটা ইচ্ছে করলেই একটু সেজেগুঁজে নিজেকে অনেকখানি আকর্ষণীয়া করে ফেলতে পারত, কিন্তু মনে হয় তার সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। মেয়েটি টেবিলে দুই হাত রেখে শান্ত কিন্তু উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে। দ্বিতীয় মেয়েটির চেহারা খাপখোলা তলোয়ারের মতো ঝকঝকে। সে অস্থির এবং উদ্বিগ্ন এবং সেটা ঢেকে রাখার একটুও চেষ্টা করছে না। মেয়েটি চেয়ারে না বসে একটু পরে পরেই টেবিলটা ঘুরে আসছে, মসৃণ মার্বেল পাথরের মেঝেতে তার জুতোর শব্দ হচ্ছে ঘরটির একমাত্র শব্দ।
আমি আমার চেয়ারে বসে সবার দিকে একনজর তাকিয়েই বুঝতে পারি আমাকে মহামান্য রিসি যেভাবে ডেকে এনেছেন, এদের চারজনকেও ঠিক সেভাবে ডেকে আনা হয়েছে। আমার মতোই এরা কেউ জানে না তারা কেন এখানে অপেক্ষা করছে।
ধারালো চেহারার মেয়েটি টেবিলটা আরো একবার ঘুরে এসে হঠাৎ আমার কাছে থেমে জিজ্ঞেস করল, আমাদের এখানে বসিয়ে রেখেছে কেন জান?
মনে হয় আমরা যেন নিজেরা একটু কথা বলি সেজন্যে।
তাহলে কথা বলছি না কেন?
মনে হয় আমরা সবাই খুব ঘাবড়ে আছি!
আমার কথা শুনে সবাই একটু হেসে ফেলল। হাসি একটি চমৎকার ব্যাপার, মানুষকে চোখের পলকে সহজ করে দেয়। হঠাৎ সবাই সহজ হয়ে গেল। ছিমছাম পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন মানুষটি বলল, আমাদের এখানে কেন এনেছে তোমরা কেউ আন্দাজ করতে পার?
আমি ভেবেছিলাম সবাই মাথা নেড়ে বলবে, না, পারি না। কিন্তু কেউ সেটি বলল না, একে অন্যের দিকে তাকাল এবং সবার চোখে সূক্ষ্ম বিস্ময়ের একটু ছায়া পড়ল। সবাই কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছে, ঠিক আমার মতোই! বারবার যে জিনিসটি আমার মাথায় উঁকি দিয়ে উঠছে এবং বারবার আমি যেটা জোর করে মাথা থেকে সরিয়ে দিচ্ছি সেটা হয়তো সত্যি। সেটা সম্ভব হতে পারে শুধুমাত্র একভাবে, আমি আবার সবার দিকে ঘুরে তাকালাম এবং লক্ষ করলাম, সবাই ঠিক আমার মতোই অন্য সবার দিকে ঘুরে তাকাচ্ছে, সবিস্ময়ে!