কিটি গম্ভীর ভঙ্গি করে মাথা নাড়তে থাকে। ঘাড়ের কাছে কোথাও নিশ্চয়ই একটা স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে। কয়দিন থেকেই দেখছি অল্পতেই তার মাথা বেসামালভাবে নড়তে থাকে।
রাতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুরেফিরে আমার শুধু ত্রিশার কথা মনে হল। আমি জীবনে সত্যিকার অর্থে এর আগে কখনো দুঃখ পাই নি। শৈশবে আমার মা আর বাবা আমাকে অনাথ আশ্রমে রেখে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন। তাদের জন্যে আমার ভিতরে ভালবাসা বা আক্রোশ কোনোটাই নেই। অনাথ আশ্রম সম্পর্কে যেরকম ভয়ঙ্কর সব গল্প শোনা যায় তার সব সত্যি নয়। পুরোপুরি রবোটের তত্ত্বাবধানে অনাথ শিশুরা মানুষ হয় সত্যি কিন্তু মাঝে মাঝে সত্যিকারের মানুষও দেখা করতে আসে। আমাদের অনাথ আশ্রমে যে মানুষটি আসতেন তিনি ছিলেন একজন মায়াবতী মহিলা। সেই মহিলাটি সপ্তাহে একবার করে এসে আমাদের সবার সাথে আলাদা করে কথা বলতেন। সত্যিকারের মানুষ খুব বেশি দেখতে পেতাম না। বলে আমরা অনাথ শিশুরা একে অন্যকে খুব ভালবাসতাম। আমার এখনো অনেকের সাথে যোগাযোগ আছে। তাদের কেউ জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি, শৈশবে মানুষের সাহচর্য ছাড়া বড় হলে মনে হয় মানুষের জীবনে কোথায় কী জানি ওলটপালট হয়ে যায়।
বিছানায় শুয়ে ছটফট করতে করতে এক সময় সত্যি আমার চোখে ঘুম নেমে এল। ঠিক যখন ঘুমে ঢলে পড়ছি তখন কিটির গলার স্বর শুনতে পেলাম, সে আমাকে ডেকে বলল, রিকি, তুমি আজকে তোমার চিঠিগুলো দেখ নি।
আমি ঘুম জড়ানো গলায় বললাম, আজ থাক, কাল ভোরে দেখব।
একটা খুব জরুরি চিঠি আছে মনে হয়। লাল রঙের বর্ডার।
থাকুক।
ইয়োরন রিসির চিঠি।
আধো ঘুমে আমি কিটির গলার স্বর ভালো করে শুনতে পেলাম না, নামটি পরিচিত মনে হল কিন্তু ধরতে পারলাম না। ঠিক ঘুমিয়ে পড়ার পূর্বমুহূর্তে মানুষের মস্তিষ্ক সম্ভবত স্মৃতি হাতড়ে কোনো তথ্য খুঁজে বের করতে চায় না। তা না হলে আমি ইয়োরন রিসি নাম শুনেও ঘুমিয়ে যেতে পারতাম না। সে
ইয়োরন রিসি পৃথিবীর সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক–ঈশ্বরের পর পৃথিবীতে তাকে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী বলে ধরা হয়।
০২. ঘুম ভাঙল খুব ভোরে
আমার ঘুম ভাঙল খুব ভোরে। ঘুমাতে ঘুমাতে সবসময় আমার দেরি হয়ে যায়, কখনোই আমি ভোরে উঠতে পারি না। আজ কিটি আমাকে ডেকে তুলল, পা ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, রিকি, ওঠ। জরুরি দরকার।
কিটি ঠাট্টা, তামাশা, রসিকতা বা রহস্য বোঝে না। কাজেই সে যদি বলে জরুরি দরকার তার অর্থ সত্যিই জরুরি দরকার। আমি ধড়মড় করে চোখ খুলে উঠে বসলাম, কী হয়েছে?
তোমার কাছে দুজন লোক এসেছে।
কোথায়?
বসার ঘরে বসে আছে।
বসার ঘরে?
হ্যাঁ।
আমি বিছানা থেকে নামলাম, কারা এরা?
বিজ্ঞান পরিষদের লোক। মনে আছে কাল রাতে তোমার কাছে ইয়োরন রিসির চিঠি এসেছিল?
কার? আমি প্রায় আর্তনাদ করে জিজ্ঞেস করলাম, কার?
ইয়োরন রিসির। বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক।
আমি চিৎকার করে বললাম, কোথায় সেই চিঠি? এতক্ষণে বলছ মানে? তোমার কপোট্রনে কি ফুটো হয়ে গেছে?
কিটি শান্ত গলায় বলল, তোমাকে আমি কাল রাতেই বলেছি। তুমি কোনো গুরুত্ব দাও নি। মনে নেই কাল তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলে? এই যে চিঠি।
আমি তার হাত থেকে চিঠিটা প্রায় ছিনিয়ে নিয়ে খুলে ফেললাম, চিঠিটা দেখে আমার চক্ষু স্থির হয়ে গেল। সর্বোচ্চ বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক ইয়োরন রিসি নিজের হাতে বিজ্ঞান পরিষদের প্যাডে লিখেছেন,
প্রিয় রিকি :
তুমি কি কাল সময় করে আমাদের কয়েকজনের সাথে একটু দেখা করতে পারবে?
–ইয়োরন রিসি।
আমার হাত কাঁপতে থাকে, চিঠিটার দিকে তাকিয়ে থেকেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি না। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সবচেয়ে ক্ষমতাশালী মানুষ নিজের হাতে একটা চিঠি লিখে আমার সাথে দেখা করতে চাইছেন! আমার সাথে? নিশ্চয়ই কোথাও কিছু ভুল হয়েছে। আমি কিটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বললাম, নিশ্চয় কিছু ভুল হয়েছে।
কিটি বলল, বাজে কথা বোলোনা। বিজ্ঞান পরিষদ কখনো কোনো ভুল করে না। মহামান্য রিসি কখনো কোনো ভুল করেন না।
কিন্তু কিন্তু আমার সাথে মহামান্য রিসির কী দরকার থাকতে পারে? আমি তখনো একটা ঘোরের মাঝে রয়ে গেছি, শুকনো গলায় বললাম, কী দরকার?
এত ব্যস্ত হওয়ার কী আছে? একটু পরেই তো জানতে পারবে। কিটি ঘুরঘুর করে পাশের ঘরে চলে গেল, সম্ভবত আমার জন্যে পরিষ্কার কাপড় জামা বের করবে। তার ভাবভঙ্গি খুব সহজ, দেখে মনে হয় বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালকের আমার সাথে দেখা করা একটা দৈনন্দিন ব্যাপার। নিচু স্তরের রবোটদের অবাক হবার ক্ষমতা নেই ব্যাপারটা আমি আগেও লক্ষ করেছি।
আমি ঘুমের কাপড়েই বসার ঘরে উঁকি দিলাম, ফুটফুটে একটা মেয়ে এবং মাঝবয়সী একজন মানুষ চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে। তাদের ভাবভঙ্গি খুব সপ্রতিভ। আমাকে দেখে মানুষটি মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, সকাল সকাল ঘুম ভাঙিয়ে দিলাম আমরা?
কী ব্যাপার! আমি শুকনো গলায় বললাম, মহামান্য রিসি কেন দেখা করতে চান আমার সাথে?
লোকটা হো হো করে হেসে বলল, আপনি সত্যিই মনে করেন মহামান্য রিসি নিজে আপনার সাথে দেখা করতে চাইবেন আর আমাদের মতো মানুষ তার কারণটা জানবে?