না না না_শ্যালক্স গ্রুন আতঙ্কে চিৎকার করে পিছনে সরে যেতে থাকে। মানুষটি নিষ্ঠুর অমানবিক, তার ভিতরে ভালবাসার কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু মানুষের প্রাচীনতম অনুভূতি ভীতি তার বুকের ভিতর লুকিয়েছিল সে জানত না।
আমি স্ক্রিন থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বললাম, আমি আর দেখতে পারছি না, তোমরা কেউ স্ক্রিনটি বন্ধ করে দেবে?
ইগা হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। য়োমি চাপা গলায় বলল, হ্যাঁ স্ক্রিনটা বন্ধ করে দাও। রবোটের ওপর নির্দেশ দেয়া আছে শ্যালক্স গ্রুনের শরীর থেকে ভাইরাসের এম্পুলটা বের করার দৃশ্যটি মনে হয় না আমি সহ্য করতে পারব।
নুবা একটা নিশ্বাস নিয়ে পিছনে সরে গিয়ে বলল, মানুষটিকে হত্যা না করে কি এম্পুলটা বের করা যেত না?
হয়তো যেত। য়োমি নুবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তার চেষ্টা করি নি। আমি খুব প্রতিহিংসাপরায়ণ মানুষ। মানুষের জগতে এই দানবটির বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই।
আমরা ছোট কন্ট্রোলঘর থেকে বের হয়ে এলাম। দূরে একটা বাই ভার্বাল নেমেছে। তার ভিতর থেকে বেশ কয়েকজন মানুষ হেঁটে হেঁটে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে, সবার সামনে ইয়োরন রিসি। আমরা তার দিকে হেঁটে যেতে থাকি।
মহামান্য ইয়োরন রিসি এক জন এক জন করে আমাদের প্রত্যেককে আলিঙ্গন করে বললেন, পৃথিবীর পক্ষ থেকে তোমাদের অভিনন্দন। এই পৃথিবী যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন তোমাদের কাছে ঋণী হয়ে থাকবে।
নুবা নরম গলায় বলল, আমার ধৃষ্টতা ক্ষমা করবেন মহামান্য ইয়োরন রিসি, কিন্তু আপনি একটু অতিরঞ্জন করেছেন। আপনার আদেশে আমরা কয়েকটা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তার বেশি কিছু নয়! সব কাজ করেছে পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ। অসংখ্য বিজ্ঞানী, অসংখ্য ইঞ্জিনিয়ার, অসংখ্য প্রতিভাবান শ্রমিক।
য়োমি মাথা নেড়ে বলল, নুবা একটুও বাড়িয়ে বলে নি। আটচল্লিশ ঘণ্টার মাঝে আমাকে একটা রবোট তৈরি করে দিয়েছে। নিখুঁত রবোট, রিকির মতো মানুষ সেই রবোট দেখে বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল!
ইগা মাথা নেড়ে বলল, আর কুরু ইঞ্জিনের সেই ব্যাপারটা। আমরা নিজেরা কি সেটা কখনো করতে পারতাম? সময়–পরিভ্রমণকে পাল্টে দূরত্ব–পরিভ্রমণ করে ফেলা? আমি নিজে তো বিজ্ঞান শিখেছি গত দু দিনে!
নুবা বলল, তার ওপর একটি নকল ত্রিনিত্রি রাশিমালা তৈরি করে দেয়া–যেটি সত্যিকারের রাশিমালার কাছাকাছি কিন্তু সত্যিকারের নয়।
হিশান হেসে বলল, সবচেয়ে চমৎকার হয়েছে কৃত্রিম পারমাণবিক বিস্ফোরণ, একেবারে তেজস্ক্রিয়তা থেকে শুরু করে শক ওয়েভ, বাতাসের ঝাঁপটা, শ্যালক্স গ্রুন এতটুকু সন্দেহ করে নি!
ইয়োররন রিসি মাথা নাড়লেন, তোমাদের কথা সত্যি। পৃথিবীর অসংখ্য মানুষ তোমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু সত্যিকারের কাজটি করেছ তোমরা। আমি সেটা জানি, তোমরাও সেটা জান!
কিন্তু–
আমি পৃথিবীর বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক, আমার আদেশ তোমরা আমার সাথে এই ব্যাপারটি নিয়ে তর্ক করবে না!
আমরা তার কথায় হেসে ফেললাম, মানুষটির মাঝে এক ধরনের বিস্ময়কর সারল্য রয়েছে যেটা অন্য কোনো মানুষের মাঝে দেখি নি।
ইয়োরন রিসি নরম গলায় বললেন, পুরো ব্যাপারটি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তোমাদের স্নায়ুর উপর নিশ্চয়ই অসম্ভব চাপ পড়েছে। এখন তোমাদের প্রয়োজন বিশ্রাম। আমি কি তোমাদের কোনোভাবে সাহায্য করতে পারি?
আমি ইয়োরন রিসির দিকে তাকালাম। বললাম, পারেন মহামান্য ইয়োরন রিসি।
তুমি বল রিকি, তুমি কী চাও।
আমি আমার পকেটে হাত দিয়ে লাল কার্ডটি বের করে ইয়োরন রিসির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমার এই কার্ডটি আপনি ফিরিয়ে নেবেন।
ইয়োরন রিসি কোমল চোখে খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে রিকি, সেটাই যদি তোমার ইচ্ছে।
ইয়োরন রিসি কার্ডটি নেবার জন্যে হাত বাড়ালেন। সাথে সাথে ইগা, হিশান, য়োমি আর নুবা তাদের নিজেদের লাল কার্ডগুলো বের করে তার দিকে এগিয়ে দেয়। ইয়োরন রিসি খানিকক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে হাসতে হাসতে বললেন, পৃথিবীর একেক জন মানুষ এই লাল কার্ডের জন্যে নিজেদের প্রাণ দিয়ে দেবে আর তোমরা অবহেলায় সেটা ফিরিয়ে দিচ্ছ?
ইগা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমরা হয়তো এই পৃথিবীর উপযুক্ত মানুষ নই মহামান্য রিসি। হয়তো কিছু গোলমাল আছে আমাদের!
ইয়োরন রিসি মাথা নাড়লেন, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই কিছু একটা গোলমাল আছে।
১১.
দীর্ঘ লিফটে করে আমি মাটির নিচে সুড়ঙ্গে নেমে এসেছি। শেষবার যখন এসেছিলাম আমার কাছে লাল কার্ড ছিল, আমি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারতাম। এখন আমার কাছে সেই লাল কার্ড নেই, মানুষের ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে নিচে নামতে হয়েছে। আমি প্রোগ্রামিং ফার্মের বাইরে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভিতরে এক শিফটের কাজ শেষ হয়েছে, শ্রমিকেরা একে একে বের হয়ে আসছে। তাদের চোখেমুখে ক্লান্তি, তাদের পোশাক ধুলায় ধূসর। আমি তীক্ষ্ণ চোখে তাদের দিকে তাকিয়ে থেকে ত্রিশাকে খুঁজতে থাকি। দাঁড়িয়ে থেকে–থেকে আমি যখন প্রায় হাল ছেড়ে দিচ্ছিলাম ঠিক তখন ত্রিশা বের হয়ে এল, তার পরনে হালকা নীল পোশাক, তার মাথায় একটা লাল রুমাল শক্ত করে বাঁধা।
আমি ভিড় ঠেলে সামনে ছুটে গেলাম, চিৎকার করে ডাকলাম, ত্রিশা ত্রিশা—