সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে মাটি থেকে উপরে উঠে আসছে, মনে হতে থাকে বিশাল একটি কীট বুঝি গা ঝাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে। প্রচণ্ড শব্দে কানে তালা লেগে যায়, তার মাঝে সময়–পরিভ্রমণ যানটি আস্তে আস্তে উপরে উঠে যাচ্ছে, গতিবেগ বেড়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি। আর কয়েক মুহূর্ত পর সময় পরিভ্রমণ যানটি পৃথিবীর আকর্ষণ ছিন্ন করে মহাকাশে ছুটে যাবে। শ্যালক্স গ্রুন এখনো জানে না সে সময়–পরিভ্রমণ করবে না–তার পরিভ্রমণ হবে দূরত্বে। সে পৃথিবী, সৌরজগৎ পার হয়ে চলে যাবে দূর কোনো এক নক্ষত্রের দিকে। তার বুকের ভিতর সিলাকিত ক্যাপসুলে থাকবে এক ভয়াবহ ভাইরাস। তার কাছাকাছি থাকবে তিশা। রবোটের অবয়বে তৈরী আমার ভালবাসার ত্রিশা। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি, সময়–পরিভ্রমণ যানের কুরু ইঞ্জিন থেকে আয়োনিত গ্যাস বের করে সেটা উপরে উঠে যাচ্ছে, খুব ধীরে ধীরে দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে, পৃথিবীর আবর্তনের সাথে সাথে গতিবেগের সামঞ্জস্য আনার জন্যে। আকস্মিক কোনো বিস্ফোরণে ধ্বংস না হয়ে গেলে আর কেউ এখন শ্যালক্স গ্রুনকে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। কোনোদিন ফিরিয়ে আনতে পারবে না। পৃথিবীর একটা অশুভ স্বপ্ন ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে মহাকাশে।
আমরা সবাই খুব সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দিলাম। সত্যিই কি পৃথিবীকে রক্ষা করা হয়েছে? নুবা দেয়াল স্পর্শ করে খুব সাবধানে ঘাসের উপর বসে পড়ল। মাথা ঘুরিয়ে আমাদের সবার দিকে তাকাল, তারপর কাঁপা গলায় বলল, আমরা কি বেঁচে গেছি?
ইগা তার ঘড়ির দিকে তাকাল, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, হা নুবা আমরা বেঁচে গেছি।
আমরা তাহলে পৃথিবীকে রক্ষা করেছি?
হ্যাঁ। আমরা পৃথিবীকে রক্ষা করেছি।
তাহলে আমরা আনন্দ করছি না কেন?
কেউ কোনো কথা বলল না। য়োমি একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, নুবা, আমি জানি না কেন আমরা আনন্দ করছি না।
ইগা একটু হেসে বলল, চল কন্টোলঘরে যাই। নিজের চোখে যদি শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পাই হয়তো তখন সত্যি সত্যি বিশ্বাস হবে। তখন হয়তো আমরা আনন্দ করতে পারব।
কাছাকাছি একটা ছোট সেলে তাড়াহুড়া করে কন্ট্রোলঘরটি তৈরি হয়েছে। স্বচ্ছ দেয়াল সরিয়ে আমরা ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে একটি বড় স্ক্রিন ছাড়া কিছু নেই। হঠাৎ করে দেখে এটাকে কন্ট্রোলঘর মনে হয় না। ইগা ছোট একটা সুইচ স্পর্শ করতেই স্ক্রিনটা আলোকিত হয়ে আসে, মাঝামাঝি একটা লাল বিন্দু জ্বলছে এবং নিভছে। নুবা জিজ্ঞেস করল, এটা কী?
শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যান।
ভিতরে কি দেখা যাবে?
পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর দেখা যাবে।
যোগাযোগের জন্যে কী ব্যবহার করা হবে?
য়োমি এগিয়ে এসে বলল, ত্রিশার মতো দেখতে যে রবোটটি পাঠিয়েছি তার সাথে রয়েছে মাইক্রো কমিউনিকেশন মডিউল। যেসব ছবি পাঠানো হবে তার রিজলিউশন খুব ভালো হবে না আগেই বলে রাখছি।
আমরা স্ক্রিনটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ সেখানে কিছু তরঙ্গ খেলা করতে থাকে। য়োমি চাপা গলায় বলল, এখন ভিতরে দেখা যাবে। কমিউনিকেশন মডিউল কাজ করতে শুরু করেছে।
নুবা বলল, রিকি তুমি সামনে যাও। কথা বল।
আমি?
হ্যাঁ। শুধু তুমিই শ্যালক্স গ্রুনের সাথে কথা বলেছ। যাও।
আমি স্ক্রিনের সামনে এগিয়ে গেলাম, খুব ধীরে ধীরে সেখানে একটা ছবি ভেসে উঠেছে। আমি বড় একটা করিডোর দেখতে পেলাম, সামনে কিছু ছোট ছোট স্ক্রিনের সামনে ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে শ্যালক্স গ্রুন। তার ভুরু কুঞ্চিত, মুখে গভীর একটা উদ্বেগের ছাপ। সে কিছু একটা স্পর্শ করে কয়েকটা বোতাম টিপতে থাকে, ছোট মাইক্রোফোনে কিছু একটা কথা বলে সোজা হয়ে দাঁড়ায়, আমি দেখতে পেলাম তার মুখ রক্তশূন্য, সেখানে এক ধরনের অমানুষিক আতঙ্ক। আমি ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন।
পৃথিবী থেকে বহুদূরে চলে গেছে, আমার কথা পৌঁছুতে একটু সময় লাগল কিন্তু যখন আমার কথা শুনতে পেল সে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে চিৎকার করে বলল, কে?
আমি।
আমি কে?
রিকি।
রিকি? রিকি!
হ্যা শ্যালক্স গ্রুন, তুমি হেরে গেছ। আমাদের কাছে তুমি হেরে গেছ। তোমাকে ত্রিনিত্রি রাশিমালা দেয়া হয় নি। অর্থহীন কিছু সংখ্যা নিয়ে তুমি এখন মহাকাশে উড়ে যাচ্ছ। বৃহস্পতি গ্রহের কাছে দিয়ে তুমি উড়ে যাবে সৌরজগতের বাইরে।
না। শ্যালক্স গ্রুন ছুটে গিয়ে তার কন্ট্রোল প্যানেলে ঝুঁকে পড়ে। হাত দিয়ে আঘাত করতে করতে চিৎকার করতে থাকে। আমরা একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিলাম, ভয়ঙ্কর মুখ করে সে ঘুরে তাকায়। তারপর হিসহিস করে বলল, ত্রিশা, ত্রিশাকে অষ্টম তোমার সামনে খুন করব। খুন করব।
আমরা প্রথমবার ত্রিশাকে দেখতে পেলাম। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখে আর ভয় নেই। তার কপোট্রনে পুরোনো স্মৃতি মুছে ফেলে এখন নতুন স্মৃতি লেখা হচ্ছে। ভালবাসাহীন এক স্মৃতি। আতঙ্কহীন এক স্মৃতি। নিষ্ঠুর প্রতিশোধের এক স্মৃতি। আমি ফিসফিস করে বললাম, শ্যালক্স গ্রুন! তুমি ত্রিশাকে স্পর্শ করবে না। তুমি স্পর্শ করতে পারবে না।
শ্যালক্স গ্রুন ঘুরে ত্রিশার দিকে তাকায় এবং হঠাৎ করে তার মুখ আতঙ্কে কদর্য হয়ে যায়। সে নিজের বুক স্পর্শ করে এক পা পিছিয়ে যায়। একটু আগে যে ত্রিশা ছিল সে আর ত্রিশা নয়, তার চোখ জ্বলছে, হাত থেকে বের হয়ে এসেছে ধারালো ধাতব ছোরা। ছায়ামূর্তিটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে যায়–