ত্রিশা হঠাৎ আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে ওঠে, তুমি কথা বলছ না কেন? কী হয়েছে রিকি?
আমি তবু কোনো কথা বলতে পারি না
ত্রিশা দুই পা এগিয়ে এসে হঠাৎ শ্যালক্স গ্রুনকে দেখতে পেল। সাথে সাথে সে পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল, কে ওটা?
শ্যালক্স গ্রুন প্রায় হাসি–হাসি মুখে বলল, আমার নাম শ্যালক্স গ্রুন, তুমি সম্ভবত আমার নাম শুনে থাকবে।
ত্রিশা একটা চিৎকার করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে পিছনে ছুটে যেতে থাকে। সে দরজার কাছে। পৌঁছানোর আগেই ক্যাচক্যাচ করে গোল দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল। সে দুই হাতে দরজায় আঘাত করতে করতে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল।
আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, দুই হাতে নিজের মুখ ঢেকে ফেললাম। হায় ঈশ্বর, তুমি কেন পৃথিবীতে এত অবিচার জন্ম দাও? কেন?
আমি আবার মাথা তুলে তাকালাম, শ্যালক্স গ্রুন শান্তমুখে তাকিয়ে আছে, মুখে এক ধরনের কোমল স্মিত হাসি। শুধুমাত্র সে-ই মনে হয় এ রকম হৃদয়হীন একটি পরিবেশেও এক ধরনের শান্তি খুঁজে পেতে পারে। শ্যালক্স গ্রুন হয়ে জন্ম নিতে হলে একজন মানুষকে কতটুকু নিষ্ঠুর হতে হয়?
আমি উঠে দাঁড়ালাম, তারপর পায়ে পায়ে হেঁটে ত্রিশার দিকে এগিয়ে গেলাম। ত্রিশা বিকারগ্রস্তের মতো কাঁদছে, আমি পিছন থেকে তাকে ধরে সোজা করে দাঁড় করালাম, সে। ঘুরে দুই হাতে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফেলল। আমার বুকে মাথা গুঁজে সে হঠাৎ আকুল হয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, রিকি তুমি আমাকে ছেড়ে যেয়ো না রিকি। আমাকে তুমি ছেড়ে যেয়ো না।
আমি দুই হাতে তার মুখ স্পর্শ করে নিজের দিকে টেনে আনি, মাথার চুলে হাত বুলিয়ে আমি তার দিকে তাকালাম।
কান্নাভেজা চোখে সে আকুল হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম এই মেয়েটি ত্রিশা নয়। এই মেয়েটি অবিকল ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট। শ্যালক্স গ্রুনের নিষ্ঠুর পরীক্ষাটি কী হবে য়োমি সেটি বুঝতে পেরেছিল, ঠিক ত্রিশার মতো দেখতে একটি রবোট তৈরি করে রেখেছিল আগে থেকে। আমাকে জানায় নি ইচ্ছে করেই। হঠাৎ করে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায় আমার কাছে।
ত্রিশার মতো দেখতে রবোটটি আমার বুকের কাপড় ধরে আবার আকুল হয়ে কেঁদে ওঠে। তার দুঃখে ভেজা ব্যথাতুর আতঙ্কিত মুখটি দেখে কেন জানি না হঠাৎ আমার চোখে পানি এসে যায়। এই মেয়েটি হয়তো সত্যিকারের মানুষ নয়, কিন্তু তার কষ্টটি সত্যি, তার দুঃখ হতাশা আর আতঙ্কটুকু সত্যি। আমার জন্যে তার ভালবাসাটুকুও সত্যি। মানুষ হয়ে জন্ম হয় নি বলে তার দুঃখ কষ্ট হতাশা আর ভালবাসাকে পায়ে দলে একজন দানবের হাতে তুলে দেয়া হবে।
আমি রবোট মেয়েটির মুখটি ধরে নিজের কাছে টেনে এনে তাকে গভীর ভালবাসায় চুম্বন করলাম। তাকে ফিসফিস করে বললাম, ত্রিশা, সোনামণি আমার, আমি আছি, আমি তোমার কাছে আছি। আমি সবসময় তোমার কাছে আছি–সবসময়–
আমার বড় বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হল যে আমি সত্যিই বুঝি থাকব ত্রিশার কাছে। হোক না সে রবোট তবুও তো সে ত্রিশা! আমার ভালবাসার ত্রিশা। কিন্তু আমি ত্রিশার কাছে থাকতে পারলাম না। শ্যালক্স গ্রুন পায়ে পায়ে আমাদের কাছে হেঁটে এল, ত্রিশাকে শক্ত করে ধরে রেখে সে গোল দরজাটি খুলে দিল। আমাকে বলল, যাও, শীতলঘরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়। এক শ বছর পর এসো, আমি তোমাকে তোমার ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব।
ত্রিশা চিৎকার করে কাঁদছে। আমি তার দিকে পিছন ফিরে এগিয়ে গেলাম। আমার শরীর কাঁপছে, আমার চোখ থেকে পানি বের হয়ে আসছে, ইচ্ছে করছে পিছনে ছুটে গিয়ে ত্রিশাকে আঁকড়ে ধরে বলি, এস ত্রিশা তুমি আমার সাথে এস।
কিন্তু আমি সোজা সামনে হেঁটে গেলাম, ফিসফিস করে নিজেকে বললাম, না, ওই মেয়েটি ত্রিশা নয়। ওই মেয়েটি একটি রবোট। রবোট। তুচ্ছ রবোট। আমি শুনতে পেলাম কাঁচক্যাচ শব্দ করে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল।
আমি সামনে তাকালাম, আবছা অন্ধকারে চার জন মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, দূর থেকে ভালো বোঝা যায় না, কিন্তু আমি জানি তারা কে। ইগা হিশান, য়োমি আর নুবা। আমাকে দেখে তারা আমার কাছে ছুটে এল। য়োমি আমার হাত ধরে বলল, কী হয়েছে রিকি? তোমার চোখে পানি কেন?
আমি চোখ মুছে বললাম, জানি না কেন। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার ত্রিশার জন্যে। সে মানুষ নয় তবু আমার কষ্ট হচ্ছে। খুব কষ্ট হচ্ছে।
য়োমি আমার হাত শক্ত করে ধরে রাখল
আমরা পাঁচ জন একটা দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে শ্যালক্স গ্রুনের কদাকার সময়–পরিভ্রমণ যানটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কুরু ইঞ্জিন দুটি এখনো চালু করা হয় নি, আমরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করে আছি। যেই মুহূর্তে কুরু ইঞ্জিন দুটি চালু করা হবে সাথে সাথে সুপ্ত গোপন প্রোগ্রামটি জীবন্ত হয়ে উঠে খুব ধীরে ধীরে সময়–পরিভ্রমণ যানটির নিয়ন্ত্রণ নিতে শুরু করবে।
প্রথমে একটা চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম, তারপর কুরু ইঞ্জিন দুটিতে মৃদু কম্পন শুরু হল। আমি বুকের মাঝে আটকে রাখা একটা নিশ্বাস খুব সাবধানে বের করে দিই, শ্যালক্স গ্রুন ইঞ্জিন দুটিকে চালু করেছে। প্রতি মুহূর্তে এখন একটু একটু করে সময়–পরিভ্রমণ যানের নিয়ন্ত্রণ তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। আস্তে আস্তে কুরু ইঞ্জিনের ভয়ঙ্কর গর্জন শোনা যেতে থাকে। থরথর করে মাটি কাঁপতে থাকে, আয়োনিত গ্যাস প্রচণ্ড বেগ বের হতে শুরু করেছে পিছন দিয়ে। আগুনের লেলিহান শিখায় চারদিক ঢেকে যেতে শুরু করেছে, কালো ধোঁয়া পাক খেয়ে খেয়ে উপরে উঠছে।