শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে একটা প্যানেলের দিকে তাকিয়ে থাকে, ছোট একটা নোট প্যাডে কিছু একটা হিসেব করে মাথার কাছে ছোট একটা গোল জানালা খুলে বাইরে তাকায় তারপর আবার ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তার মুখে এক ধরনের সন্তুষ্টির ছাপ। সে একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি আগে কখনো পারমাণবিক বোমা ফেলি নি–চমৎকার একটি জিনিস। মুহূর্তের মাঝে তেজস্ক্রিয়তা কতগুণ বেড়ে যায়!
আমি কোনো কথা না বলে ক্রুদ্ধ চোখে তার দিকে তাকিয়ে থাকি। শ্যালক্স গ্রুন আমার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, বিস্ফোরণটি খুব কাছাকাছি করা হল, মনে হচ্ছে এত কাছে না করলেও হত। আমি নিশ্চিত হতে চাইছিলাম তোমরা আমাকে ধোঁকা দিতে চেষ্টা করছ কি না।
আমি দাতে দাঁত ঘষে বললাম, তুমি সেটা নিয়ে কখনো নিশ্চিত হতে পারবে না।
আমার প্রয়োজনও নেই। এই মুহূর্তে আমি শুধু একটা জিনিস নিয়ে নিশ্চিত হতে চাই।
কী?
আমি যেন নিরাপদে আরো এক শ বছর ভবিষ্যতে যেতে পারি।
আমি কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
শ্যালক্স গ্রুন নিচু গলায় বলল, তুমি আমাকে সাহায্য করবে। আমার দুটি কুরু ইঞ্জিন পাল্টে নূতন দুটি ইঞ্জিন লাগিয়ে দেবে, আমি জানি তুমি সেটা করে দেবে। কেন জান?
কেন?
শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় কোনো কথা বলল না। তার বড় চেয়ারটি ঘুরিয়ে সে সোজাসুজি আমার দিকে তাকাল। তার মুখটি হঠাৎ কেমন জানি বিষণ্ণ দেখাতে থাকে, সে এক ধরনের ক্লান্ত গলায় বলল, আমি বড় নিঃসঙ্গ।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে। য়োমির কথা মনে পড়ল আমার–অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা পরীক্ষা করবে শ্যালক্স রুন। এটাই কি সেই পরীক্ষা?
শ্যালক্স গ্রুন তার হাত তুলে খুব মনোযোগ দিয়ে আঙুলগুলো পরীক্ষা করতে করতে বলল, আমার একজন সঙ্গী প্রয়োজন। আমি বড় একা। তাছাড়া দীর্ঘদিন আমি কোনো রমণীর দেহ স্পর্শ করি নি।
আমি চমকে উঠলাম, চাপা গলায় চিৎকার করে বললাম, কী বলতে চাইছ তুমি?
আমি তোমার ভালবাসার মেয়েটিকে আমার সাথে নিয়ে যাব। কী নাম মেয়েটির?
মনে হল হঠাৎ আমার মাথার মাঝে একটা ছোট বিস্ফোরণ হল। আমি আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না–হাঁটু ভেঙে বসে পড়লাম, মাথা নাড়তে নাড়তে বললাম, না–না–না–
কী নাম মেয়েটির?
না-না-
শ্যালক্স গ্রুন হঠাৎ তীব্র স্বরে চিৎকার করে ওঠে, কী নাম মেয়েটির?
ত্রিশা।
ত্রিশা! কী সুন্দর নাম!
আমি দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকি। হঠাৎ সবকিছু আমার কাছে অর্থহীন হয়ে আসে, বিশাল শূন্যতায় আমার বুকের মাঝে হা হা করে ওঠে! হায় ঈশ্বর! তুমি এ কী করলে?
শ্যালক্স গ্রুন নরম গলায় বলল, উঠে দাঁড়াও তুমি। আমার খুব বেশি সময় নেই। কাজ শুরু করে দাও।
শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে যোগাযোগ মডিউলটি এগিয়ে দেয়। আমি তবু স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
এক শ বছর পর আমি ত্রিশাকে ফিরিয়ে দেব। তুমি ইচ্ছে করলে শীতলঘরে এক শ বছর অপেক্ষা করতে পার। আমার কাছে এসো, আমি তখন তোমার হাতে ত্রিশাকে তুলে দেব। কথা দিচ্ছি।
আমি হিংস্র চোখে শ্যালক্স গ্রুনের দিকে তাকিয়ে থাকি। ঝাঁপিয়ে পড়ে তার কণ্ঠনালী চেপে ধরে মানুষটিকে শেষ করে দেয়ার একটি অদম্য ইচ্ছে আমার মাথার মাঝে পাক খেতে থাকে।
কিন্তু আমি জানি আমি সেটা করতে পারব না। পৃথিবীর সমস্ত মানুষের জীবন সে তার বুকের মাঝে একটি সিলাকিত কার্বনের ক্যাপসুলের মাঝে লুকিয়ে রেখেছে। একটি ছোট ভুলে সেই জীবন হারিয়ে যেতে পারে। আমি অসহায় আক্রোশে একটি দানবের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
১০. সময়-পরিভ্রমণ যান
শ্যালক্স গ্রুনের সময়-পরিভ্রমণ যানটির একপাশে নিচু হয়ে নেমে গেছে শেষ মাথায় একটি গোল দরজা। আমি এই দরজা দিয়ে ঢুকেছি, ত্রিশাও এই দরজা দিয়ে ঢুকবে। আমি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে আছি, এখনো পুরো ব্যাপারটি আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।
ক্যাচক্যাচ শব্দ করে হঠাৎ গোল দরজাটা খুলে গেল। ত্রিশাকে কি ধরে এনেছে এখন? সে কি চিৎকার করে কাঁদছে? আমার বুকের ভিতর যন্ত্রণায় দুমড়ে মুচড়ে উঠতে থাকে। আমি কেমন করে ত্রিশার মুখের দিকে তাকাব?
গোল দরজায় একজন মানুষের ছায়া পড়ল, আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম। ত্রিশা পায়ে পায়ে ভিতরে এসে দাঁড়াল। একটি লাল রুমাল দিয়ে মাথার চুলগুলো শক্ত করে বাধা, হালকা নীল রঙের একটা পোশাক। পায়ে বিবর্ণ একজোড়া জুতো।
দরজার কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ত্রিশা মাথা ঘুরে তাকায়। তার মুখে এক ধরনের অসহনীয় আতঙ্ক। সে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, রিকি, তুমি কোথায়?
এই যে আমি এখানে।
ত্রিশা মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকাল, কিন্তু আমার কাছে ছুটে এল না। সেখানে দাঁড়িয়ে বলল, আমাকে ওরা এখানে এনেছে কেন?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। ত্রিশা আবার জিজ্ঞেস করল, রিকি, তুমি কথা বলছ না কেন? এটি কোন জায়গা, এখানে এ রকম আবছা অন্ধকার কেন?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, ত্রিশা, তুমি আমাকে ক্ষমা কর, ত্রিশা।
তুমি এ কথা কেন বলছ?
তোমার ওপরে খুব বড় একটা অবিচার করা হবে ত্রিশা।
ত্রিশার গলার স্বর হঠাৎ কেঁপে যায়, কী অবিচার?
আমি ঠোঁট কামড়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ত্রিশার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারি না।