ভিতরে গাঢ় অন্ধকার। আমি দেয়াল ধরে দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়ে রইলাম তবু অন্ধকারে আমার চোখ সয়ে গেল না। এক সময় কাঁপা গলায় ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন
ভিতরের গাঢ় অন্ধকার থেকে শ্যালক্স গ্রুনের গলার স্বর ভেসে এল, তুমি এসেছ?
হ্যাঁ।
ত্রিনিত্রি রাশিমালা এনেছ আমার জন্যে?
ছোট একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক দিয়েছে আমাকে। তার মাঝে ত্রিনিত্রি রাশিমালা থাকার কথা।
তুমি সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে এ রকম হেঁয়ালি করে কেন কথা বলছ?
কারণ আমরা চেষ্টা করছি তোমাকে ধ্বংস করতে।
এক মুহূর্তের জন্যে শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না, তারপর হঠাৎ সে হা হা করে হেসে উঠল। অত্যন্ত ক্রুর সেই হাসি, আমার শরীর কেমন জানি কাঁটা দিয়ে ওঠে। হাসতে হাসতেই সে বলল, তোমার সাহস দেখে আমি এক ধরনের আনন্দ পাই! ব্যাপারটি ভালো কি না সে ব্যাপারে আমি নিঃসন্দেহ নই কিন্তু ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে অত্যন্ত কৌতুককর। তোমরা কি আমাকে ধ্বংস করতে পারবে?
সেটি ঠিক করা হবে এই কিছুক্ষণের মাঝে।
হঠাৎ করে ঘরের আলো জ্বলে ওঠে, আমি আবার শ্যালক্স গ্রুনকে সামনাসামনি দেখতে পেলাম, একটা দীর্ঘ টেবিলের অন্যপাশে বসে আছে। মাথায় এলোমেলো কালো চুল, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ, মনে হয় সেই দৃষ্টি আমার শরীর ভেদ করে যাচ্ছে। একটু মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে তুমি জানতে পারবে?
হ্যাঁ।
কেমন করে?
তোমাকে যে ক্রিস্টাল ডিস্কটি দিয়েছি তার মাঝে যে রাশিমালাটি রয়েছে সেটি একটি অর্থহীন সংখ্যা না সত্যিকারের ত্রিনিত্রি রাশিমালা তুমি সেটা জান না। তোমাকে সেটা আমি নিজে থেকে বলব না, আমি বললেও তুমি বিশ্বাস করবে না। তোমার নিজেকে সেটা পরীক্ষা করে দেখতে হবে। তুমি নিশ্চয়ই জান ত্রিনিত্রি রাশিমালার মাঝে একটা অনিশ্চয়তা রয়েছে। যখন তুমি একটি অংশ পরীক্ষা করে দেখবে তখন অন্য একটি অংশ অস্পষ্ট হয়ে যাবে।
শ্যালক্স গ্রুন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে বললাম, ত্রিনিত্রি রাশিমালার যে অংশ তোমার কাছে অস্পষ্ট সেই অংশটি আমাদের অস্ত্র। আজ থেকে এক শ বছর পর তুমি যখন আবার পৃথিবীতে নেমে আসবে পৃথিবী তখন তোমার জন্যে প্রস্তুত থাকবে।
তুমি মিথ্যা কথা বলছ।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে ওঠে, এই মানুষটি অসম্ভব ধূর্ত। আমি কি সত্যিই তাকে ধোঁকা দিতে পারব? শ্যালক্স গ্রুন আবার চাপা স্বরে বলল, তুমি আমার সাথে মিথ্যা কথা বলছ, মানুষ মিথ্যা কথা বললে আমি বুঝতে পারি।
আমি চুপ করে রইলাম। শ্যালক্স গ্রুন আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, কিছু একটা পরিকল্পনা তোমাদের আছে সেটা কী আমি এখনো জানি না। তুমি জান আমি যদি চাই আমি সেটা যখন ইচ্ছে জানতে পারব। আমি মানুষকে অসম্ভব যন্ত্রণা দিতে পারি। মনোবিজ্ঞানে আমার মতো চরিত্রের একটি গালভরা নাম রয়েছে।
হঠাৎ আতঙ্কে আমার বুক কেঁপে ওঠে।
আমি জিভ দিয়ে আমার শুকনো ঠোঁটকে ভিজিয়ে বললাম, তুমি আমাকে ভয় দেখাতে চাইছ?
না, আমি আলাদা করে কাউকে ভয় দেখাতে চাই না। তার প্রয়োজন হয় না। সাধারণ মানুষ এমনিতেই আমাকে ভয় পায়।
আমি শ্যালক্স গ্রুনের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলাম, কী ভয়ঙ্কর নিষ্করুণ দৃষ্টি। আমার বুকের ভিতর শিরশির করতে থাকে অনেক কষ্টে নিজেকে শক্ত করে আমি বললাম, তুমি কি আমার মুখে আমাদের পরিকল্পনাটি জানতে চাও?
হ্যাঁ, চাই।
কিন্তু আমি নিজে থেকে বলব না। তোমার সেটা জোর করে বের করতে হবে।
শ্যালক্স গ্রুন দীর্ঘ সময় আমার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল তারপর হঠাৎ গলার স্বর পাল্টে বলল, তুমি ত্রিনিত্রি রাশিমালাটি আমার মূল কম্পিউটারে প্রবেশ করাও।
আমি গত দুই দিন এই ব্যাপারটি কেমন করে করতে হয় খুব ভালো করে শিখে এসেছি। শ্যালক্স গ্রুন আদেশ দেয়া মাত্র কাজে লেগে গেলাম। দীর্ঘ জটিল এবং সময়সাপেক্ষ কাজ। এক সময় সেটি শেষ হল, আমি যোগাযোগ মডিউলটি শ্যালক্স গ্রুনের দিকে এগিয়ে দিয়ে দেয়ালের পাশে সরে দাঁড়ালাম।
আমি ইচ্ছে করলে এখন সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস করে দিতে পারি? যেখানে ইচ্ছে পারমাণবিক বোমা ফেলতে পারি? বাঁধ ভেঙে পানিতে শহর ডুবিয়ে দিতে পারি?
পার।
ইচ্ছে করলে আমি চোখের পলকে লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারি?
হ্যা পার। কিন্তু ত্রিনিত্রি রাশিমালার উদ্দেশ্য কিন্তু সেটা নয়। তার উদ্দেশ্য সভ্যতার নিয়ন্ত্রণ। আমি আশা করব তুমি সেটা ব্যবহার করবে বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মতো।
আমি কীভাবে সেটা ব্যবহার করব সেটা আমাকেই ঠিক করতে দাও।
শ্যালক্স গ্রুন যোগাযোগ মডিউলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে অত্যন্ত সহজ গলায় খুব কাছাকাছি একটা পারমাণবিক বিস্ফোরণের আদেশ দিল। মানুষের জনবসতির উপর এত সহজে কেউ একটি এ রকম ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণ ঘটানোর আদেশ দিতে পারে নিজের চোখে না দেখলে আমার বিশ্বাস হত না। মুহর্তের মাঝেই প্রথমে তীব্র আলোর ঝলকানি আমাদের চোখ ধাধিয়ে দিল। এক মুহূর্ত পর প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ, সাথে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড যেন পায়ের নিচে দুলে উঠল। কয়েক মুহূর্ত আশ্চর্য এক ধরনের নীরবতা তারপর হঠাৎ যেন প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ে সমস্ত এলাকা উড়ে যেতে শুরু করল।
আমি দেয়াল খামচে ধরে কোনোমতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। শ্যালক্স গ্রুনের সময়–পরিভ্রমণ যানের ভিতর অসংখ্য মনিটর তীব্র স্বরে শব্দ করতে শুরু করে, একটি বড় লালবাতি বারবার জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। কোথাও কিছু একটা ভেঙে গেছে বলে সন্দেহ হতে থাকে।