এক চামচ?
হ্যাঁ।
সেই জন্যে আমি মানসিক ভারসাম্যহীন?
হ্যাঁ। তুমি কম্পিউটারে তোমার জার্নাল পড় নি। চিঠি খুলে দেখ নি। এখন এত বেলা হয়েছে তুমি তবু আমাকে রাতের খাবার গরম করতে বল নি। তুমি মানসিক ভারসাম্যহীন। তুমি দুঃখী। তুমি মনে হয় এখন জানালা দিয়ে লাফ দেবে।
আমি খানিকক্ষণ কিটির দিকে তাকিয়ে থেকে মৃদু স্বরে বললাম, কিটি তুমি একেবারে সত্য কথা বলেছ! আমার সত্যি ইচ্ছে করছে জানালা থেকে লাফ দিয়ে জীবন শেষ করে দিই।
আমি আগেও লক্ষ করেছি, আমার মনের গভীরের কথা যেগুলো কখনোই অন্য কোনো মানুষকে জানতে দিই না আমি অবলীলায় এই নির্বোধ রবোটটিকে বলে ফেলি। রবোটটি কখনোই আমার অনুভূতির গভীরতা ধরতে পারে না, আজকেও পারল না। তার চোখের ঔজ্জ্বল্য কয়েক মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, আমারও তাই ইচ্ছে করছে।
তোমার কী ইচ্ছে করছে?
তোমার সাথে লাফ দিই।
কেন?
তুমি যখন মরে যাবে তখন আমাকে এমনিতেই ধ্বংস করে ফেলবে। চার মাত্রার রবোটে তেতাল্লিশ দশমিক তিন পয়েন্ট কপোট্রন এখন কোথাও নেই। তাই আমার মনে হয় তোমার সাথে লাফ দেয়াই ভালো। তোমার যদি কোনোকিছুর প্রয়োজন হয় আমি কাছাকাছি থাকব।
প্রয়োজন?
হ্যাঁ। তুমি যখন নিচে পড়তে থাকবে তখন যদি কিছু প্রয়োজন হয়।
আমি এক ধরনের স্নেহের চোখে এই পরিপূর্ণ নির্বোধ রবোটটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। সে খানিকক্ষণ আমাকে লক্ষ্য করে হঠাৎ ঘরের ভিতরে গিয়ে প্রায় সাথে সাথে একটা ইলেকট্রনিক নোট প্যাড নিয়ে ফিরে এল। নোট প্যাডটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তুমি কি কিছু লিখে যেতে চাও?
কী লিখব?
মানুষেরা যখন নিজেরা নিজেদের সার্কিট নষ্ট করে ফেলে তখন সাধারণত তার আগে কিছু লিখে যায়।
কী লেখে?
আমার সার্কিট নষ্ট করার জন্যে কেউ দায়ী নয়।
সার্কিট নষ্ট?
হ্যাঁ। তোমরা মৃত্যু বল সেটাকে। সেটাও লিখতে পার, আমার মৃত্যুর জন্যে কেউ দায়ী নয়।
আমি কিটির দিকে তাকিয়ে হঠাৎ খুকখুক করে হেসে ফেললাম, কিটি সাথে সাথে ঘুরে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হঠাৎ হেঁটে ঘরের ভিতরে চলে গেল। আমি পিছন থেকে ডেকে বললাম, কী হল? তুমি কোথায় যাও?
খাবার গরম করি। তুমি খাবে।
হঠাৎ করে?
তুমি হেসেছ, তার মানে তোমার মানসিক ভারসাম্যতা ফিরে এসেছে। তুমি এখন জানালা দিয়ে লাফ দিবে না।
আমি এক ধরনের ঈর্ষার দৃষ্টিতে কিটির দিকে তাকিয়ে থাকি। কী ভয়ঙ্কর রকমের সহজ সরল তার হিসেব–জীবন যদি সত্যিই এ রকম সহজ হত কী চমৎকারই না হত সবকিছু।
আমার আবার ত্রিশার কথা মনে পড়ল, আমি এখন যেরকম কষ্টে ছটফট করছি ত্রিশাও নিশ্চয়ই কোথাও ঠিক আমার মতো কষ্টে ছটফট করছে। আমি মানুষকে ভালবাসতে জানতাম না, ত্রিশা আমাকে শিখিয়েছে। আমি যখন ভালবাসতে শিখেছি তখন সে আমাকে ছেড়ে চলে গেছে। আমি তাকে পেতে পারতাম, সেও আমাকে পেতে পারত, কিন্তু তবু আমরা একজন আরেকজনকে পেলাম না। পেলাম না কারণ ত্রিশা সত্যিকার জীবনের কথা ভেবেছে। যে জীবনে ঘুম থেকে উঠে সুড়ঙ্গ দিয়ে অতল গহ্বরে কাজ করতে যেতে হয়, দিনশেষে ক্লান্ত দেহে লম্বা লাইন দিয়ে খাবারের প্যাকেট তুলে আনতে হয়, মাসের শেষে টার্মিনালে নিজের একাউন্টে শেষ রসদটি যত্ন করে খরচ করতে হয়, শীতের রাতে বুভুক্ষের মতো আলোকোজ্জ্বল উষ্ণ দালানের দিকে হিংসাতুর চোখে তাকিয়ে থাকতে হয়। ত্রিশা সে জীবন চায় নি, নিজের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সে ভয় পেয়েছে। সে যে জীবন চেয়েছে। আমি তাকে সেই জীবন দিতে পারব না। চাইলে হয়তো পারতাম কিন্তু আমি কখনো চাই নি। তাই আমি শহরতলিতে তিন শ এগার তালায় মেঘের কাছাকাছি একটা ঘরে নির্বোধ একটা রবোটকে নিয়ে দিন কাটিয়ে দিই। হ্রদের কাছে পাইন গাছের আড়ালে আমার মেটে রঙের কাঠের বাসা নেই, আমার ঘরে মেগা কম্পিউটার নেই, হ্রদে নিউক্লিয়ার নৌকা নেই, বাগানে বাই ভার্বাল নেই, বাসার পিছনে নরম রোদে বসে থাকা আমার স্ত্রী নেই, ঘাসে লুটোপুটি খাওয়া আমার সন্তান নেই। আমি জানি আমার থাকবে না, ত্রিশা তাই আমার কাছে এসেও এল না।
রাতে কিটি গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাকে স্যুপ খেতে দেখল। খাওয়া শেষ করার পর বলল, ঠিকমতো গরম হয়েছিল?
হ্যাঁ, কিটি।
তুমি জান গতকাল স্যুপের মাঝে মাংস তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ছিল।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আপেক্ষিক তাপও ছিল বেশি। তাই স্যুপের তাপমাত্রা ঠিক উনাশি ডিগ্রিতে পৌঁছায় নি।
উনাশি ডিগ্রি?
হ্যাঁ। তোমার বান্ধবী ত্রিশা উনাশি ডিগ্রির স্যুপ খেতে পছন্দ করে। কালকে সে স্যুপটি পছন্দ করে নি। মনে হয় সে জন্যেই তোমাকে ছেড়ে চলে গেছে।
আমি আবার একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, না কিটি। স্যুপের তাপমাত্রা উনাশি ডিগ্রি হয় নি বলে কখনো কোনো মেয়ে কাউকে ছেড়ে যায় নি।
গিয়েছে। কিটি গম্ভীর ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি খবরের কাগজে পড়েছি একটা মানুষ সবুজ রঙের ট্রাউজারের সাথে লাল রঙের প্যান্ট পরেছিল বলে একটি মেয়ে তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল। সবুজ আর লাল মানুষের চোখে পরিপূরক রং জান তো? ছেলে এবং মেয়ের ভালবাসা হলে ছোট ছোট জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায়।
ভালবাসা মানে তুমি বোঝ কিটি?
একটু একটু বুঝি। দুজন মানুষের টিউনিং ফ্রিকোয়েন্সি এক হওয়ার মানে ভালবাসা। রেজোনেন্স হওয়া মানে ভালবাসা।