আবার পুরোটুকু বলে শেষ করতে অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল, আমি নিজেও জানতাম আমার এত রকম ঘুঁটিনাটি মনে ছিল। মানুষের মস্তিষ্ক নিঃসন্দেহে একটি অবিশ্বাস্য জিনিস। আমার কথা শেষ হবার পর য়োমি অনেকক্ষণ আমার দিকে জ্বলজ্বল চোখে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, কী হয়েছে তোমার?
কিছু হয় নি। ভাবছি।
কী ভাবছ?
তুমি জান আমি কী ভাবছি। শ্যালক্স গ্রুন একজন সাধারণ মানুষ নয়। ত্রিনিত্রি রাশিমালা হাতে নিয়ে সে পরীক্ষা করে দেখবে এটা সত্যি কি না। মানুষটির বিষাক্ত জিনিসের দিকে একটা আসক্তি আছে প্রথমেই নিশ্চয়ই কিছু বিষাক্ত কেমিক্যাল ছড়িয়ে ছিটিয়ে দেবে। একটি দুটি মহাকাশযান ধ্বংস করবে, কিছু উপগ্রহ উড়িয়ে দেবে ইতস্তত পারমাণবিক বোমা ফেলবে–কিন্তু সেগুলো সহজ! পৃথিবীর মূল কম্পিউটারে এই সবকিছুই তৈরি করা সম্ভব। পৃথিবীর তথ্যকেন্দ্র থেকে এইসব খবর প্রচার করা সম্ভব, বাতাসে নির্দিষ্ট পরিমাণ কেমিক্যাল, তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে দেয়া সম্ভব, বিস্ফোরণ শকওয়েভ সবকিছু তৈরি করা। সম্ভব। কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন খুব ধূর্ত মানুষ–সে আরো একটা কিছু করবে–অত্যন্ত নিষ্ঠুর একটা পরীক্ষা, আমি সেটা বোঝার চেষ্টা করছি।
বুঝতে পেরেছ?
না। এখনো বুঝতে পারি নি। সেটা যতক্ষণ বুঝতে না পারছি আমি শান্তি পাচ্ছি না।
য়োমি টেবিল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ছোট ঘরটিতে হাঁটতে থাকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে খাঁচায় আটকে রাখা একটি বন্য পশুর মতো। মেয়েটির চেহারায় একটি আশ্চর্য সতেজ ভাব যেটি সাধারণত চোখে পড়ে না। য়োমি হঠাৎ ঝড়িয়ে গিয়ে বলল, রিকি।
কী হল?
চল বাইরে থেকে ঘুরে আসি।
কোথায় যাবে?
জানি না। বদ্ধ ঘরে আটকে থাকলে আমার মাথা কাজ করে না।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, ঠিক আছে তাহলে, চল যাই।
বাইরের ঘরে হিশান এবং ইগার সাথে একজন বুড়োমতো মানুষ বসেছিল। মানুষটিকে খানিকটা উত্তেজিত দেখাচ্ছে, শুনতে পেলাম মানুষটি ক্রুদ্ধ স্বরে বলছে, তোমাদের ধারণা শ্যালক্স গ্রুন সাংঘাতিক প্রতিভাবান মানুষ
ইগা একটু হকচকিয়ে গিয়ে বলল, আমরা তো তাই জানতাম! এক শ বছর আগের প্রযুক্তি ব্যবহার করে কেউ যদি ভবিষ্যতে চলে আসতে পারে–
তুমি ভবিষ্যতে যেতে চাও? আমি তোমাকে ভবিষ্যতে পাঠিয়ে দেব। কীভাবে?
তোমাকে শীতলঘরে ঘুম পাড়িয়ে দেব। তোমার শরীর তরল নাইট্রোজেন তাপমাত্রায় রেখে দেব এক শ বছর। জেগে উঠে দেখবে ভবিষ্যতে চলে এসেছ
কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন তো সেভাবে আসে নি। চতুর্মাত্রিক সময়ক্ষেত্র ছেদ করে
বুড়োমতো মানুষটি হাত ঝাঁকিয়ে পুরো ব্যাপারটি উড়িয়ে দিয়ে বলল, চার শ বছর আগে আইনস্টাইন বলে গিয়েছিলেন, গতিবেগ বাড়াতে থাক সময় ধীর হয়ে যাবে। শ্যালক্স গ্রুন তাই করেছে, অসম্ভব শক্তিশালী কয়েকটা কুরু ইঞ্জিন চুরি করে একটা বাক্সের সাথে জুড়ে দিয়েছে। আর কিছু না–
হিশান মাথা নাড়তে থাকে, আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না, যদি গতিবেগ বাড়িয়ে সে সময়কে আটকে রাখার চেষ্টা করেছে তাহলে তার এই গ্রহ নক্ষত্র পার হয়ে বহুদূরে চলে যাবার কথা ছিল! সে তো পৃথিবীতেই আছে–
বুড়োমতো মানুষটা মুখ কুঁচকে বললেন, হ্যাঁ, সেই জন্যে তাকে খানিকটা বাহবা দেয়া যায়। গতি দু রকমের হতে পারে। তুমি সময়ের সাথে অবস্থানের পরিবর্তন করছ কিংবা তোমার চারপাশে যে ক্ষেত্রটি আছে সেটাকে পরিবর্তন করছ। প্রচণ্ড শক্তি ক্ষয় করে সেটা করা যায়–কাজটি বিপজ্জনক কিন্তু শ্যালক্স গ্রুন বিপজ্জনক কাজকে ভয় পায় না।
ইগা হঠাৎ চেয়ার থেকে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, তার মানে আপনি বলছেন, প্রচণ্ড গতিবেগ এবং শ্যালক্স গ্রুন যেটা করছে সেটা খুব কাছাকাছি একটা ব্যাপার?
হা। মনে কর প্রচণ্ড মাধ্যাকর্ষণ বলের জন্যে একটা জায়গায় ক্ষেত্রটি সঙ্কুচিত হয়ে আছে–
ইগা বাধা দিয়ে বলল, যদি আপনাকে বলা হয় আপনি কুরু ইঞ্জিনটির মাঝে কিছু একটা পরিবর্তন করে দেন, যেন সে ভবিষ্যতে না গিয়ে প্রচণ্ড গতিবেগ নিয়ে এই সৌরজগতের বাইরে চলে যাবে আপনি সেটা করতে পারবেন?
আমি নিজে সেটা পারব না, কিন্তু গোটা চারেক যান্ত্রিক রবোট, মূল কম্পিউটারে খানিকটা সময়, কিছু ভালো প্রোগ্রামার, কিছু যন্ত্রপাতি দেয়া হলে এমন কিছু কঠিন নয়! কিন্তু আমাকে এটা জিজ্ঞেস করছ কেন? সত্যি এটা করতে চাও নাকি?
য়োমি আমার হাত ধরে বাইরে টেনে নিতে নিতে বলল, বিজ্ঞানের কথা শুনতে ভালো লাগছে না–চল বাইরে যাই।
কিন্তু ইগা বুদ্ধিটা মন্দ বের করে নি। ভবিষ্যতে না পাঠিয়ে শ্যালক্স গ্রুনকে পাঠিয়ে দেবে বিশ্বজগতের বাইরে!
.
আমরা যখন বাইরে এসেছি তখন অন্ধকার হয়ে এসেছিল। এলাকাটি নির্জন, মানুষজন নেই তাই আমাদের পিছনে দূরত্ব রেখে যে চারটি ছায়ামূর্তি হাঁটছে তারা যে নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষ এবং রবোট বুঝতে কোনো অসুবিধা হল না। কেউ সবসময় আমাকে চোখে। চোখে রাখছে ব্যাপারটা চিন্তা করতে ভালো লাগে না, কিন্তু এখন আমাদের কিছু করার নেই।
আমি আর য়োমি পাশাপাশি হাঁটছি–ঠিক কী কারণে জানি না আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে হল। আমি ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম, সাথে সাথে য়োমি আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার ত্রিশার কথা মনে পড়েছে?
হ্যাঁ। সবসময় মনে পড়ে।