আমি রিহাসের চোখের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললাম, রিহাস, যদি মনে কর কেউ এসে বলে তোমার জীবন তুচ্ছ, তুমি তুচ্ছ, তোমার বেঁচে থাকার কোনো অর্থ নেই, তুমি কী বলবে?
আমি?
হ্যাঁ, তুমি।
আমি এক ঘুসিতে তার মুখের ছয়টা দাঁত খুলে নিয়ে বলব, জাহান্নামে যাও!
আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেললাম। রিহাস খানিকক্ষণ আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে বলল, তোমার আজকে কী হয়েছে? রাজনীতির লোকদের মতো কথা বলছ কেন?
আর বলব না!
সেটাই ভালো–সে আরো কী একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন দরজায় শব্দ হল। নিশ্চয়ই লানা এসেছে।
রিহাস যেরকম বিশাল, লানা ঠিক সেরকম ছোটখাটো। তার লাল চুল শক্ত করে পিছনে টেনে বাধা। ঠিক সুন্দরী বলতে যা বোঝায় লানা তা নয়, কিন্তু তার চেহারায় এক ধরনের স্নিগ্ধ কমনীয়তা রয়েছে। লানা তার ভারী কোট খুলে দু হাত ঘষে উষ্ণ হতে হতে বলল, খুব একটা অবাক ব্যাপার হয়েছে বাইরে।
কী হয়েছে?
বিশাল একটা বাই ভার্বাল দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। শুধুমাত্র ছবিতে এ রকম বাই ভার্বাল দেখা যায়–চিত্রতারকারা এ রকম বাই ভার্বালে করে যায়।
আমি একটু এগিয়ে এলাম, কী হয়েছে সেই বাই ভার্বালে?
ভিতরে একটা মেয়ে, কী সুন্দর দেখতে গায়ের রং কী উজ্জ্বল!
কী হয়েছে সেই মেয়ের?
আমাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি লানা?
রিহাস অবাক হয়ে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি বললাম হ্যাঁ, আমি লানা। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি আর রিহাস এই বসন্তকালে বিয়ে করবে? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি কেমন করে জান? মেয়েটি হেসে বলল, আমি সব জানি। এই নাও তোমাদের বিয়ের উপহার। আমার হাতে একটা ছোট খাম ধরিয়ে দিল। আমি নিতে চাচ্ছিলাম না, যাকে আমি চিনি না, কেন তার থেকে উপহার নেব? মেয়েটা তখন কী বলল জান?
কী?
বলল, তুমি আর রিহাস পৃথিবীর খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষকে খুব খুশি করেছ। আমরা তার পক্ষ থেকে উপহার দিচ্ছি। তোমাকে নিতে হবে।
তাই বলল?
হ্যাঁ।
রিহাস এগিয়ে গিয়ে খামটা হাতে নিয়ে বলল, দেখি কী আছে খামে। খামটা খুলে সে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে থাকে।
অনেকক্ষণ পর সাবধানে বুক থেকে একটা নিশ্বাস বের করে বলল, নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে কোথাও।
কেন? কী আছে খামে?
আমাদের দুজনের জন্যে দক্ষিণের সমুদ্রোপকূলে দু সপ্তাহের জন্যে একটি কটেজ। যাতায়াতের খরচ। সরকারি ছুটি, হাতখরচের জন্যে ভাউচার।
লানা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায়। সত্যি?
হ্যাঁ, এই দেখ। নিশ্চয়ই কিছু একটা ভুল হয়েছে।
লানা মাথা নাড়ল, বলল, না ভুল হয় নি। মেয়েটি আমাকে স্পষ্ট বলেছে। খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ দিয়েছে। এত গুরুত্বপূর্ণ যে তার লাল কার্ড রয়েছে।
লাল কার্ড?
হা। রিহাস জ্বলজ্বলে চোখে আমার দিকে তাকাল, রিকি, শুনেছ, লাল কার্ডের একজন মানুষ আমাকে আর লানাকে বিয়ের উপহার দিয়েছে। শুনেছ?
আমি জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে আনি, শুনেছি।
মানুষটা কে? কখন আমি তাকে খুশি করেছি? কীভাবে করেছি?
আমি রিহাসের হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস, একজন মানুষ যখন খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যায় তখন তাকে আর বোঝা যায় না। তোমরাও কোনোদিন এই মানুষটিকে বুঝবে না। কোনোদিন তাকে খুঁজেও পাবে না!
তুমি কেমন করে জান?
আমি জানি না। আন্দাজ করছি।
রিহাস আমার দিকে তাকিয়ে বলল, রিকি, তুমি আমার জন্যে আজকে সৌভাগ্য নিয়ে এসেছ। প্রথমে টিউব ঠিক হয়ে গেল, তারপর গরম বাসের হিটার, এখন এই সাংঘাতিক উপহার! তাই না লানা?
লানা মিষ্টি করে হেসে বলল, হ্যাঁ। কিছু কিছু মানুষ হয় এ রকম। তারা সবার জন্যে সৌভাগ্য নিয়ে আসে। আমি আগেও দেখেছি রিকি সবসময় সৌভাগ্য নিয়ে এসেছে।
আমি মনে মনে বললাম, তোমার কথা সত্যি হোক লানা। শ্যালক্স গ্রুনের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যে সবচেয়ে বেশি যেটা দরকার সেটা হচ্ছে সৌভাগ্য। অনেক অনেক সৌভাগ্য।
.
গভীর রাত্রিতে আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে হল। কোথায় আছে এখন? কী করছে? তাকে একটিবার দেখার জন্যে আমার বুক হাহাকার করতে থাকে। আমি বিছানায় দুই হাঁটুর মাঝে মুখ রেখে চুপ করে বসে থাকি। টেবিলের উপর আমার লাল কার্ডটি পড়ে রয়েছে। আমি সেটা স্পর্শ করে ত্রিশার খোঁজ নিতে পারি, তাকে দেখতে পারি, আমার কাছে নিয়ে আসতে পারি।
কিন্তু আমি কিছুই করলাম না। চুপ করে বসে রইলাম।
০৬. আমরা পাঁচ জন
আমরা পাঁচ জন যে ঘরটিতে বসে আছি সেটি বেশ ছোট। ঘরটির দেয়াল কাঠের, দুপাশে বড় বড় জানালা, সেই জানালা দিয়ে বিস্তৃত প্রান্তর দেখা যায়। বাইরে ঝড়ো বাতাস, সেই বাতাসে গাছের পাতা নড়ছে। ঘরের ভিতরে বসে আমরা বাতাসের শো শো শব্দ শুনতে পাই, কেন জানি না এই শব্দে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের শূন্যতার জন্ম দেয়।
বড় জানালার একটিতে নুবা পা তুলে বসে আছে। বাইরের দিকে তাকিয়ে থেকে সে তরল গলায় বলল, কী সুন্দর এই জায়গাটা!
হিশান হা হা করে হেসে বলল, তুমি সুন্দর বলছ এই জায়গাটাকে? জেনারেল ইকোয়া শুনলে হার্টফেল করে মারা যাবেন!
য়োমি বলল, বেচারাকে দোষ দিয়ে লাভ কী? আমাদের পাহারা দেবার জন্যে বাইরে এই ঝড়ো বাতাসে কতজন বসে আছে তুমি জান?
নুবা হাত নেড়ে বলল, দরকার কী পাহারা দেবার? আমরা কি ছোট শিশু।