আমি তার ঝাঁকুনি থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, এর মাঝে আশ্চর্য হবার কী আছে? আমি কি তোমার বাসায় আগে কখনো আসি নি?
কিন্তু আজকেই আমি তোমার বাসায় খোঁজ করেছিলাম!
সত্যি?
হ্যাঁ। ভারি মজার ব্যাপার হয়েছে আজ। ভারি মজা!
কী?
তোমার বাসায় খোঁজ করেছি, যোগাযোগ মডিউলটি ধরেছে তোমার রবোট!
কিটি?
হ্যাঁ। কিটি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, রিকি কোথায়? সে কী বলল জান?
কী?
হাঃ হাঃ হাঃ। তুমি শুনলে বিশ্বাস করবে না, সে বলল রিকিকে বিজ্ঞান পরিষদের মহাপরিচালক মহামান্য ইয়োরন রিসি ডেকে পাঠিয়েছেন! রিহাস আবার বিকট স্বরে হাসতে শুরু করল!
তাই বলল?
হ্যাঁ। রিহাস অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে তার চোখ মুছে বলল, আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেন ডেকেছে রিকিকে? সে কী বলল জান?
কী?
বলল, মনে হয় পৃথিবীর কোনো সমস্যা হয়েছে। রিকি তার সমাধান করবে! রিহাস আবার হাসতে শুরু করে। তার দিকে তাকিয়ে আমিও হাসতে শুরু করি। মুহূর্তে আমার মনের সমস্ত গ্লানি কেটে যায়, বুকের ভিতর এক ধরনের সজীব আনন্দ এসে ভর করে।
রিহাস আমার হাত ধরে আমাকে টেনে ঘরের ভিতরে নিয়ে আসে। আমি তার প্রবল আপ্যায়ন থেকে নিজেকে রক্ষা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে খোঁজ করছিলে কেন?
অনেকদিন থেকে দেখা নেই তাই ভাবলাম একটু খোঁজ নিই। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
রিহাস লাজুক মুখে বলল, লানার কথা মনে আছে?
লানা? তোমার বান্ধবী?
হ্যাঁ। আমি আর লানা ঠিক করেছি বিয়ে করব। এই বসন্তেই।
সত্যি? আমি কনুই দিয়ে রিহাসের পেটে চা দিয়ে বললাম, সত্যি?
রিহাস দাঁত বের করে হেসে বলল, সত্যি! লানাকে আজ আমি খেতে আসতে বলেছি, তাই ভাবছিলাম তোমাকেও ডাকি! কী আশ্চর্য সত্যি সত্যি তুমি এসে হাজির! এটাকে যদি ভাগ্য না বল তাহলে ভাগ্যটা কী?
আমি মাথা নেড়ে রিহাসের কথায় সায় দিলাম। রিহাস আমার হাত ধরে বার কয়েক ঝাঁকুনি দিয়ে ঘরের ভিতর অদৃশ্য হয়ে গেল। ভিতরে খানিকক্ষণ নানা ধরনের শব্দ হয়, সম্ভবত কিছু একটা রান্না হচ্ছে। একটু পরেই সে ফিরে এসে বলল, তোমার খিদে পেয়েছে তো? মাংসের স্টু রান্না হচ্ছে। কৃত্রিম মাংস নয়, একেবারে পাহাড়ি ভেড়ার রান! অনেক কষ্টে জোগাড় করেছি।
রিহাসের ঘরে আসবাবপত্র বিশেষ নেই, কিন্তু যেটুকু আছে সেটুকু খুব সাজানো গোছানো। ঘরের একপাশে ছোট টিউব। আমি সেদিকে তাকাতেই রিহাস মাথা নেড়ে বলল, টিউবটা এক সপ্তাহ থেকে নষ্ট হয়ে আছে। বিশ্বাস কর, কম করে হলেও তিনবার খবর পাঠিয়েছি, কারো কোনো গরজ নেই।
আমি অন্যমনস্কতাবে টিউবটার সুইচ স্পর্শ করতেই সেটা চালু হয়ে ঘরে হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসে। রিহাস অবাক হয়ে বলল, আরে! ঠিক হয়ে গেছে দেখি! কেমন করে ঠিক হল?
আমি জানি না।
কী আশ্চর্য! আমি একটু আগে চেষ্টা করলাম কিছুতেই চালু হল না।
টিউবে জেনারেল জিক্লোকে সমাহিত হবার খবরটি দেখানো হচ্ছিল। কীভাবে মারা গেছেন সেটি ব্যাখ্যা করা হয় নি, একটি দুর্ভাগ্যজনক দুর্ঘটনা বলে ঘোষণা করা হচ্ছে। একটু আগে আমরা এই শব্দটি ঠিক করে দিয়েছিলাম–শ্যালক্স গ্রুনের কথা এই মুহূর্তে কাউকে বলা সম্ভবত সুবিবেচনার কাজ নয়।
রিহাস ঘরের একপাশে হিটারের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের উত্তাপ পরীক্ষা করতে করতে বলল, আশ্চর্যের পর আশ্চর্য!
কী হয়েছে?
গরম বাতাসের হিটারটি নষ্ট হয়েছিল সেটাও ঠিক হয়ে গেছে! দেখ কী চমৎকার উষ্ণ বাতাস!
আমি রিহাসের কাছে দাঁড়িয়ে বাতাসের প্রবাহে হাত রেখে উষ্ণতাটা অনুভব করতে করতে বললাম, ভারি চমৎকার।
কিন্তু কেমন করে হল এটা?
আমি জানি না। মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
আমি রিহাসের মুখের দিকে তাকালাম, তার চেহারায় একটি অল্পবয়স্ক বালকের ছাপ। রয়েছে। আমরা যখন অনাথ আশ্রমে ছিলাম সে সবসময় আমাকে অন্য দুরন্ত শিশুদের হাত থেকে রক্ষা করত। আমি সবসময় রিহাসের জন্যে এক ধরনের মমতা অনুভব করে এসেছি। আজকেও তার কিশোরসুলভ মুখের দিকে তাকিয়ে আমি এক ধরনের গভীর ভালবাসা অনুভব করি। আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, রিহাস
কী হল?
তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কী কথা?
তোমার কি মনে হয় মানুষের জীবন অর্থহীন?
রিহাস ভেবাচেকা খেয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আমার প্রশ্নটি সে ধরতে পেরেছে মনে হয় না। প্রাণপণ চেষ্টা করে বোঝার চেষ্টা করতে থাকে আমি তার সাথে কোনো ধরনের রসিকতা করার চেষ্টা করছি কি না। খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী বললে?
বলেছি, তোমার কি মনে হয় বেঁচে থাকার কোনো অর্থ আছে?
অর্থ থাকবে না কেন?
এই যে, কী কষ্টের একটা জীবন! তুমি আর আমি অনাথ আশ্রমে মানুষ হয়েছি–বাবা মা নেই, আদর করে কথা বলার একটি মানুষ নেই। বেঁচে থাকার জন্যে কী কষ্ট, সূর্য ওঠার আগে তুমি ঘুম থেকে উঠে সুড়ঙ্গে করে কাজ করতে যাও, ফিরে আস সন্ধেবেলা, খাবারের লাইনে দাঁড়িয়ে
কী হল তোমার? রিহাস আমার দিকে বড় বড় চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি কি গোপন রাজনীতির দলে নাম লিখেছ?
না।
তাহলে?
তাহলে কী?
তাহলে এ রকম মন খারাপ করা কথা বলছ কেন? অনেক কষ্ট করতে হয় সত্যি– কিন্তু সবাই কষ্ট করে। তুমি শুধু কষ্টটা দেখছ কেন? ভালো জিনিসটা দেখছ না কেন?
ভালো কোন জিনিসটা?
কত কী আছে। লানার কথা ধর–লানার সাথে আমি যখন থাকি তখন আমার মনে হয় আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।