শ্যালক্স গ্রুন তার হাতটি আমার দিকে এগিয়ে দেয়, আমি দুই পা এগিয়ে গিয়ে তার হাত স্পর্শ করলাম। সাথে সাথে কেন জানি না আমার সমস্ত শরীর হঠাৎ শিউরে ওঠে।
০৫. দেয়ালে হেলান দিয়ে
আমি দেয়ালে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে আছি। আমার হাতে একটা সাদা তোয়ালে, আমি সেটা দিয়ে আমার হাতটা মোছার চেষ্টা করছি। আমাকে ঘিরে অন্য চার জন বসে আছে। নুবা বলল, রিকি, তোমার সত্যি আর হাতটা মোছার প্রয়োজন নেই।
হ্যাঁ। হিশান বলল, হাতে শ্যালক্স গ্রুনের যেটুকু চিহ্ন ছিল মুছে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
আমি জানি। আমি এর মাঝে কম করে হলেও দশবার হাত ধুয়ে এসেছি তবুও কেমন জানি গা ঘিনঘিন করছে, মনে হচ্ছে কিছু অশুভ একটা কিছু ঘটে গেছে। ব্যাপারটা আমি ঠিক বোঝাতে পারব না, আমার কখনো এ রকম হয় নি।
নুবা নরম গলায় বলল, রিকি। আমার মনে হয় তুমি বাইরে থেকে ঘুরে আস।
হ্যাঁ।
হিশান আর ইগা একসাথে মাথা নাড়ে। তোমার কাজ তুমি করেছ, তুমি এখন এক দিনের জন্যে ছুটি নাও।
কিন্তু আমাদের সময় নেই–
আমি জানি। কিন্তু তুমি সত্যি এখন কোনো কাজে আসছ না। একজন মানুষ হাত থেকে অদৃশ্য কিছু মুছে ফেলার চেষ্টা করছে–ব্যাপারটা দেখা খুব মজার ব্যাপার না।
আমি সবার মুখের দিকে তাকালাম, সত্যি তোমরা মনে কর আমি এখন যেতে পারি?
হ্যাঁ, সত্যি আমরা মনে করি।
আমি সাথে সাথে উঠে দাঁড়ালাম, আমার সত্যিই খানিকক্ষণের জন্যে এই জীবনটির কথা ভুলে যাওয়া দরকার।
.
বিজ্ঞান পরিষদের বিশাল ভবন থেকে বের হয়ে আমি খানিকক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। পাশে বড় রাস্তা, তার বিভিন্ন স্তরে নানা আকারের বাই ভার্বাল যাচ্ছে আসছে। দুপাশে বড় বড় আলোকোজ্জ্বল ভবন। রাস্তায় নানা ধরনের মানুষ। এটি শহরের ভালো এলাকাটি, মানুষগুলোর চেহারায়, পোশাকে তার স্পষ্ট ছাপ রয়েছে। অপরিচিত মানুষের মুখের দিকে তাকিয়ে তাদের অনুভূতি বোঝার চেষ্টা করতে আমার খুব ভালো লাগে। আমি আগেও দেখেছি শহরের দরিদ্র এবং অবস্থাপন্ন অঞ্চলের মানুষের অনুভূতির মাঝে খুব বেশি তারতম্য নেই।
রাস্তায় দাঁড়িয়ে মানুষজনকে লক্ষ করতে করতে হঠাৎ দুজন তরুণ–তরুণীকে হাত ধরে হেঁটে যেতে দেখলাম। তরুণীটির চেহারার সাথে কোথায় জানি ত্রিশার চেহারার মিল রয়েছে, আমার হঠাৎ করে কেমন জানি বিষণ্ণ লাগতে থাকে। আমি বুকের ভিতরে এক ধরনের নিঃসঙ্গতা অনুভব করি, ঘনিষ্ঠ একজনের সাথে কথা বলার জন্যে হঠাৎ বুকটি হা হা করতে থাকে। কিন্তু আমার কোনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেই।
আমি ক্লান্ত পায়ে রাস্তা ধরে কয়েক পা হেঁটেছি আর ঠিক তখন আমার পাশে অত্যন্ত সুদৃশ্য একটি বাই ভার্বাল এসে দাঁড়াল।
দরজা খুলে কমবয়সী একটি মেয়ে লাফিয়ে নেমে এসে বলল, মহামান্য রিকি!
আমাকে বলছ?
অবশ্যি! কোথায় যাবেন আপনি?
আমাকে নিয়ে যাবে তুমি?
অবশ্যি!
ঠিক তখন আমার মনে পড়ল আজ সকালে আমার জীবন পাল্টে গেছে, আমি পৃথিবীর এক শ সতের জন লাল কার্ডের অধিকারীদের এক জন। আমি একবার ভাবলাম মেয়েটিকে চলে যেতে বলি, কিন্তু কী মনে করে আমি বাই ভার্বালে উঠে বসলাম।
কোথায় যাবেন মহামান্য রিকি?
তোমার আমাকে মহামান্য রিকি ডাকার কোনো প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু রিকি ডাকতে পার।
মেয়েটি খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
বাই ভার্বালটি নিঃশব্দে উপরে উঠে একটা নির্দিষ্ট গতিপথে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে নেয়। আমি প্রায় মুগ্ধ হয়ে এই যন্ত্রটিকে দেখছিলাম, তখন মেয়েটি আবার জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথায় যাবেন?
আমি জানি না।
মেয়েটি হেসে ফেলল, যেন খুব মজার কথা একটা শুনেছে। হাসতে হাসতে বলল, জাতীয় শিক্ষকেন্দ্রে খুব সুন্দর একটি নৃত্যানুষ্ঠান হচ্ছে।
না, আমি মাথা নাড়লাম, আমার মানুষের ভিড়ে যেতে ইচ্ছে করছে না।
তাহলে কি জাতীয় মিউজিয়ামে–
না। আমার মস্তিষ্কটিকে একটু বিশ্রাম দিতে হবে। খুব কষ্ট হয়েছে আজ। মিউজিয়ামে গেলে বিশ্রাম হবে না।
আপনাকে কি তাহলে বাসায় নিয়ে যাব?
না। বাসাতেও যেতে ইচ্ছে করছে না।
আপনার কোনো বন্ধুর বাসায়?
আমার বন্ধু বলতে গেলে নেই। আমি যে অনাথ আশ্রমে বড় হয়েছি সেখানে যারা ছিল তাদের সাথে খানিকটা যোগাযোগ আছে।
যাবেন তাদের বাসায়?
মন্দ হয় না। এই বাই ভার্বাল নিয়ে যাওয়া যাবে না। শহরের সবচেয়ে দুস্থ এলাকায় থাকে তারা!
সেটি নিয়ে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।
সত্যি সত্যি সেটা নিয়ে আমার কোনো চিন্তা করতে হল না। মেয়েটি কীভাবে কীভাবে জানি দুস্থ এলাকার সরু একটা রাস্তার পাশে বিল বাই ভার্বালটি নামিয়ে ফেলল।
আমি দরজা খুলে বের হতেই মেয়েটি জিজ্ঞেস করল, আমি কি আপনার জন্যে অপেক্ষা করব?
মাথা খারাপ হয়েছে তোমার? বাড়ি যাও এখন। মেয়েটি আমাকে অভিবাদন করে বাই ভার্বালের মাঝে ঢুকে যায়, আমার কেন যেন সন্দেহ হতে থাকে মেয়েটি আসলে আমার জন্যে অপেক্ষা করতে থাকবে।
আমার অনাথ আশ্রমের যে বন্ধুটির সাথে আমি দেখা করতে এসেছি তার নাম রিহাস। সে শক্তসমর্থ বিশাল একটি মানুষ, কিন্তু তার বুদ্ধিমত্তা অপরিণতবয়স্ক কিশোরের মতো। তার ভিতরে এক ধরনের সারল্য আছে যেটা আমাকে বরাবর মুগ্ধ করে এসেছে।
আমি তার দরজায় শব্দ করতেই সে দরজা খুলে দিল। আমাকে দেখে সে একই সাথে বিস্মিত এবং আনন্দিত হয়ে ওঠে। সে দুই হাতে শক্ত করে আমার হাত ধরে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বলল, কী আশ্চর্য! রিকি তুমি এসেছ আমার বাসায়! কী আশ্চর্য!