তুমি ভয় পেয়েছ।
হ্যাঁ।
কিন্তু তুমি তীত নও। যে আমাকে নির্বোধ বলতে পারে সে ভীতু হতে পারে না। মানুষের প্রাণের জন্যে আমার কোনো মমতা নেই।
জানি
তুমি কেন আমাকে নির্বোধ মনে কর?
কারণ তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলবে বলে ভয় দেখিয়েছ।
আমি ভয় দেখাই নি। আমি সত্যি সত্যি সেটা করতে চাই।
আমার সমস্ত শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, মানুষটি সত্যি কথা বলছে। সত্যিই সে পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চায়। আমি জিভ দিয়ে আমার শুকনো ঠোঁট ভিজিয়ে বললাম, তুমি কেন পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও?
আমি সেটা বহুবার বলেছি। পৃথিবীর সব ডাটাবেসে সে তথ্য আছে।
আমি তোমার নিজের মুখ থেকে শুনতে চাই।
কেন?
কারণ আমি পৃথিবীকে তোমার হাত থেকে রক্ষা করব। তোমার সম্পর্কে আমার জানা প্রয়োজন।
তুমি একা পৃথিবীকে রক্ষা করবে?
না, আমার সাথে আরো চার জন অসম্ভব প্রতিভাবান মানুষ রয়েছে।
তোমরা পাঁচ জন মিলে পৃথিবীকে রক্ষা করবে?
না। আমাদের সহযোগিতা করবে পৃথিবীর সমস্ত মানুষ সমস্ত জ্ঞান বিজ্ঞান—
চুপ কর কণ্ঠস্বরটি হঠাৎ তীব্র স্বরে আমাকে ধমকে ওঠে, হঠাৎ করে আমি সত্যিকারের এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল একটা স্রোত বয়ে যেতে থাকে। ভয়ঙ্কর অন্ধকারে আমি দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে থাকি, আমি প্রথমবার অনুভব করতে পারলাম অন্ধকারে যে প্রাণীটির সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি সেটি মানুষ নয়, সেটি একটি দানব। আমি কুলকুল করে ঘামতে থাকি। আবার আমি ত্রিশার কথা ভাবতে শুরু করি। আমার চোখের সামনে তার চেহারা ভেসে ওঠে, আমার দিকে তাকিয়ে যেন হাসছে, লাল ঠোঁট ঝকঝকে স্ফটিকের মতো দাঁত। বাতাসে তার রেশমের মতো কালো চুল উড়ছে।
তুমি কার কথা ভাবছ?
মানুষটি এই ঘুটঘুটে অন্ধকারেও আমাকে স্পষ্ট দেখছে, আমি দেয়াল স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে আছি সেখান থেকে আমার শরীরের আরো অনেক তথ্য পেয়ে যাচ্ছে।
কথা বল।
আমি বলতে চাই না।
কেন?
এটি আমার খুব ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাছাড়া
তাছাড়া কী?
তুমি হয়তো সেটা বুঝবে না। মানুষ সম্পর্কে তোমার ধারণাটি অত্যন্ত বিচিত্র। তোমার ধারণা পৃথিবীতে মানুষের জন্ম পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। পৃথিবীর মানুষকে ধ্বংস করে তুমি তাদের যন্ত্রণার অবসান ঘটিয়ে দেবে।
তোমার কথা খানিকটা সত্যি।
কিন্তু সেটি সত্যি নয়। পৃথিবীতে মানুষের জন্ম ব্যর্থ হয় নি। যতদিন পৃথিবীতে একজন মানুষের জন্যে অন্য মানুষের ভালবাসা থাকবে ততদিন মানবজন্ম বৃথা হবে না।
চুপ কর তুমি। চুপ কর—
না, আমি চুপ করব না। আমাকে মেরে ফেলতে চাইলে তুমি মেরে ফেলতে পার, কিন্তু আমি যেটা বলতে চাই সেটা বলবই। জ্ঞান বিজ্ঞান সত্যতা শিল্প সাহিত্য মানুষের জীবনের মাপকাঠি না– মানুষের জীবনের মাপকাঠি হচ্ছে একের জন্যে অন্যের ভালবাসা। তুমি সেটা জান না। তুমি সেটা কোনোদিন জানবে না।
আমি মানুষটি দেখতে পারছি না, মানুষটি এখন সম্ভবত আমাকে মেরে ফেলবে, আমার হয়তো চুপ করে থাকাই উচিত ছিল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি, নিজেকে হঠাৎ খুব অসহায় মনে হয়। দীর্ঘ সময় কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় আমি বুঝি কফিনের মাঝে একটি মৃতদেহকে নিয়ে বসে আছি। আমি চাপা গলায় ডাকলাম, শ্যালক্স গ্রুন।
বল।
তুমি কি আমাকে মেরে ফেলবে?
এখনো জানি না।
আমি কি তোমার সাথে কথা বলতে পারি?
কী কথা বলতে চাও?
তুমি কি নিজের মুখে আমাকে একবার বলবে কেন তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও?
তুমি বলতে পারবে?
আমি?
হ্যাঁ, তুমি।
আমি একটা লম্বা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, চেষ্টা করতে পারি।
কর।
তোমার মানুষের জন্যে কোনো মমতা নেই। সম্ভবত শৈশবে খুব হৃদয়হীন কিছু মানুষ তোমার ওপর খুব অবিচার করেছিল। তুমি তার প্রতিশোধ নিতে চাও।
আমি একটু থামতেই শ্যালক্স গ্রুন বলল, বলতে থাক।
তুমি ভয়ঙ্কর স্বার্থপর। তোমার মৃত্যুর পর পৃথিবী বেঁচে থাকুক আর ধ্বংস হোক তাতে তোমার কিছু আসে যায় না। তাই তুমি এই খেলাটি বেছে নিয়েছ, তুমি বনাম পৃথিবী।
আমি কয়েক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বললাম, আমি কি ভুল বলেছি?
না।
অনেক ধন্যবাদ শ্যালক্স গ্রুন
শ্যালক্স গ্রুন কোনো কথা বলল না। আবার দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। আমি অন্ধকারে দেয়াল ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ভয়ঙ্কর অন্ধকার স্নায়ুর ওপর একটা চাপ সৃষ্টি করে, আমি কেমন জানি এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করতে থাকি। যখন মনে হল শ্যালক্স গ্রুন আর কোনো কথা বলবে না, আমি কিছু জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিলাম ঠিক তখন সে বলল, তোমরা পৃথিবীকে রক্ষা করবে ঠিক করেছ?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
আমি মোটামুটি নিঃসন্দেহ তুমি সত্যি সত্যি সব মানুষকে মেরে ফেলতে চাও। কিন্তু সেটি যখন করা হবে তুমি নিজেও মারা যাবে। কিন্তু তুমি মৃত্যুর জন্যে এখনো প্রস্তুত নও। পৃথিবীর মানুষের সাথে তুমি যে খেলাটি খেলছ সেটা তুমি আরো একটু খেলতে চাও। আমার ধারণা তুমি আমার কাছে কোনো প্রস্তাব দেবে।
প্রস্তাব?
হ্যাঁ। কিছু একটা তুমি দাবি করবে। অসম্ভব একটা দাবি। সে দাবি পূরণ করতে না পারলে তুমি পৃথিবীর সব মানুষকে ধ্বংস করে দেবে।
আর সেই দাবি যদি পূরণ করা হয়?
তাহলে তুমি আরো ভবিষ্যতে পাড়ি দেবে। আরো এক শ বছর সামনে।