আমরা কেউই পারি না নুবা। ইগা একটা হাত বাড়িয়ে নুবার হাত স্পর্শ করে বলল, কিন্তু আমাদের কোনো উপায় নেই।
আমরা পাঁচ জন চুপচাপ বসে থাকি খানিকক্ষণ। কেউ কিছু বলছি না কিন্তু তবু মনে হচ্ছে একজন আরেকজনের সাথে কথা বলছি–মনে হচ্ছে একজন আরেকজনকে চিনি বহুকাল থেকে। এক সময় আমি হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, সময় নষ্ট করে লাভ নেই। আমার মনে হয় এখনই যাওয়া দরকার, কী বল?
সবাই দ্বিধান্বিতভাবে মাথা নাড়ল। হিশান বলল, যেতেই যদি হয় তাহলে যত তাড়াতাড়ি যেতে পার ততই ভালো।
নুবা ঘুরে আমার কাছাকাছি এসে আমাকে গভীর ভালবাসায় আলিঙ্গন করে বলল, আমরা তোমার মঙ্গল কামনা করছি রিকি।
আমি নরম গলায় বললাম, আমি জানি।
আমার কখনো কোনো পরিবার ছিল না, কোনো আপনজন ছিল না। আমি সবসময় নিঃসঙ্গ একাকী বড় হয়েছি। হঠাৎ করে এই বিশাল ঘরে চার জন মানুষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মনে হল আমি বুঝি আর নিঃসঙ্গ নই। আমারও আপনজন আছে–আমারও পরিবার আছে। কথাটি আমি বলতে গিয়ে থেমে গেলাম, মুখ ফুটে বলতে পারলাম না।
হয়তো বলার প্রয়োজনও নেই, এরা নিশ্চয়ই জানে আমি কী বলতে চেয়েছি। এরা সবাই অসাধারণ মানুষ!
» ০৪. শ্যালক্স গ্রুন
শ্যালক্স গ্রুন যে জিনিসটি করে পৃথিবীতে নেমে এসেছে সেটি দেখতে একটি কদাকার দালানের মতো। কোনো দরজা জানালা নেই, বিবর্ণ দেয়াল স্থানে স্থানে পুড়ে ঝলসে আছে। পুরো জিনিসটি একটু কাত হয়ে বড় কিছু পাথরের উপর বসে রয়েছে। চারপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা, উচ্চচাপের বিদ্যুৎপ্রবাহ হচ্ছে আমি কান পেতে এক ধরনের চাপা গুঞ্জন শুনতে পেলাম। আরো দূরে উঁচু কংক্রিটের দেয়াল, দেখে বোঝা যায় তাড়াহুড়া করে তৈরি হয়েছে। শক্তিশালী লেজার দিয়ে খুব সহজেই বিস্তীর্ণ এলাকা ঘিরে রাখা যায় কিন্তু এখানে কোনো ঝুঁকি নেয়া হয় নি, শক্ত কংক্রিটের দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে। প্রথম দুটি গেটে মানুষের প্রহরা ছিল তারপরের দুটিতে রবোট। শেষ গেটটিতে কোনো প্রহরা ছিল না। কিন্তু আমি নিশ্চিত সেখানে অদৃশ্য কোনো লেজাররশ্মি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে। আমার কাছে লাল কার্ডটি ছিল বলে ঢুকতে পেরেছি না হয় ঢোকা নিঃসন্দেহে খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার।
আমি কদাকার ঘরটির সামনে দাঁড়িয়ে রইলাম, পুরো এলাকাটিতে এক ধরনের অশুভ চিহ্ন, কেন জানি অকারণে মন খারাপ হয়ে যায়। আমার হঠাৎ ত্রিশার কথা মনে পড়ল। কোথায় আছে ত্রিশা? কেমন আছে? আমি ইচ্ছে করলেই লাল কার্ডটি স্পর্শ করে ত্রিশার কথা জানতে পারি, পৃথিবীর যেখানেই সে থাকুক না কেন আমার সামনে তার ত্রিমাত্রিক হলোগ্রাফিক ছবি ভেসে আসবে। আমার হঠাৎ তাকে খুব দেখার ইচ্ছে করল, অনেক কষ্ট করে আমি ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলাম। বলা যেতে পারে পৃথিবীর সব মানুষের জীবন এখন বিপন্ন, এই মুহূর্তে একজন মানুষের জন্যে ব্যাকুল হওয়া হয়তো স্বার্থপরের কাজ। আমি কদাকার ঘরটির দিকে এগিয়ে গেলাম, হঠাৎ নিচে থেকে ক্যাচক্যাচ শব্দ করে গোলাকার একটা ছোট দরজা খুলে গেল। আমি একটু চমকে উঠি–আমার জন্যেই ভোলা হয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শ্যালক্স গ্রুন কি কোনো গোপন জানালা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে?
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, আমাকে এখন ভেতরে ঢুকতে হবে। জীবন্ত কি ফিরে আসতে পারব আমি? গোল অন্ধকার দরজায় পা দেবার আগে হঠাৎ আমার লাল কার্ডটার। কথা মনে পড়ল, ইচ্ছে করলে সেটাকে একটা ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যায়। শ্যালক্স গ্রুনের সাথে একটা অস্ত্র নিয়ে দেখা করা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে? আমি এক মুহূর্ত ভেবে লাল কার্ডটা পকেট থেকে বের করে বাইরে ছুঁড়ে দিলাম, ছোট একটা ঝোঁপের নিচে সেটা অদৃশ্য হয়ে গেল।
সামনের দরজাটি হোট। ভিতরে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–আমি একটু দ্বিধা করে মাথা নিচু করে ভিতরে ঢুকতেই ঘরঘর শব্দ করে পিছনের দরজাটি বন্ধ হয়ে গেল। ভিতরে ঝাঁজালো গন্ধ, ভাপসা গরম এবং ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমি সাবধানে দেয়াল ধরে সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালাম, সাথে সাথে শুনতে পেলাম কে যেন ভারি গলায় বলল, তুমি কেন এসেছ?
আমি চমকে উঠে বললাম, আমি–আমি তোমার সাথে দেখা করতে এসেছি।
কেন?
আমি এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই জান কেন।
কণ্ঠস্বরটি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ জানি।
আমি ঘুটঘুটে অন্ধকারে প্রাণপণ চেষ্টা করে মানুষটিকে দেখার চেষ্টা করতে থাকি, কিন্তু চারদিকে দুর্ভেদ্য অন্ধকারের দেয়াল, আমি কাউকে দেখতে পেলাম না।
কণ্ঠস্বরটি আবার বলল, তুমি জান এর আগে যে আমার সাথে দেখা করতে এসেছিল সে অত্যন্ত নির্বোধ ব্যক্তি ছিল।
বুদ্ধিমত্তা খুব আপেক্ষিক ব্যাপার। তাছাড়াও এটি বহুমাত্রিক।
তুমি কি নির্বোধ?
কোনো কোনো বিষয়ে সবাই নির্বোধ। তুমি অসাধারণ প্রতিভাবান মানুষ বলে শুনেছি কিন্তু অন্তত একটি ব্যাপারে তুমিও নির্বোধ।
কণ্ঠস্বরটি দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। প্রতি মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল অন্ধকার থেকে একটি বুলেট ছুটে এসে আমাকে ছিন্নভিন্ন করে দিবে। আমি ত্রিশার কথা ভাবতে চাইলাম, যখনই আমি অসহায় অনুভব করি আমি ত্রিশার কথা ভাবি।