মহিলাটি উদ্বিগ্ন গলায় বলল, তুমি নিজে থেকে ইন্টারফেসটা খোলার চেষ্টা করো না কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে লাগানো আছে–চিকিৎসক রোবট ছাড়া আর কেউ খুলতে পারবে না।
আমার রেগে ওঠার কথা ছিল কিন্তু কোনো একটা বিচিত্র কারণে আমি কেন জানি রেগে উঠতে পারলাম না। ভেতরে ভেতরে আমি কেমন জানি অবসন্ন এবং উদাসীন অনুভব করতে থাকি।
মহিলাটি লাল চুলের মানুষটিকে বলল, শিরান, তুমি ত্রাতুলকে দাঁড় করিয়ে দাও।
ঠিক আছে, ক্লিশা। শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমাকে ধরে দাঁড় করিয়ে দিল। আমার প্রথমে মনে হল হাঁটুতে কোনো জোর নেই, আমি পা ভেঙে প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম কিন্তু দুই পাশ থেকে দুজন আমাকে সময়মতো ধরে ফেলল। খানিকক্ষণ চেষ্টা করার পর আমি নিজের পায়ের উপর দাঁড়াতে পারলাম। দেয়াল ধরে ঘরের ভেতরে একটু ঘুরে এসে আমি তিনজন মানুষের দিকে তাকালাম, বললাম, রিকি, শিরান এবং ক্লিশা–তোমরা আমাকে একটা সত্যি কথা বলবে?
ক্লিশা একটু ব্যাকুল চোখে বলল, অবশ্যই বলব।
তোমরা আমাকে কেন এনেছ? আমাকে কী করেছ? এখন আমাকে দিয়ে কী করবে?
ক্লিশা অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, দেখো ত্রাতুল, একটি খুব বড় প্রজেক্টে মানুষের কিছু অস্তিত্বের প্রয়োজন। আইন খুব কঠিন তাই আমরা সবার মস্তিষ্ক ম্যাপ করতে পারি না। তোমার ট্রাকিওশান নেই বলে তোমারটা করেছি। এর বেশি কিছু নয়।
আমার মস্তিষ্কের ম্যাপ মানে আমি। যার অর্থ এখন আমার দুটো অস্তিত্ব।
বলতে পার।
আমার অন্য অস্তিত্ব এখন কোথায়?
একটি বিশাল তথ্য কেন্দ্রে আছে।
কীভাবে আছে? সে কি কষ্টে আছে?
ক্লিশা হাসল, বলল, না সে কষ্টে নেই। তাকে কোনো ক্ষেত্র দেওয়া হয় নি। তার শরীর নেই, ইন্দ্রিয় নেই, কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই।
আমি একটু উত্তেজিত হয়ে বললাম, কিন্তু সেটি নিশ্চয়ই ভয়ংকর একটি অনুভূতি। একজন মানুষের কোনো কিছু অনুভব করার ক্ষমতা নেই আমি তো চিন্তাও করতে পারি না।
শিরান নামের লাল চুলের মানুষটি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, এখন এসব চিন্তা করে লাভ নেই। দেখো কত তাড়াতাড়ি নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াতে পার। যত তাড়াতাড়ি তুমি দাঁড়াতে পারবে তত তাড়াতাড়ি তুমি তোমার নিজের জগতে যেতে পারবে।
সবকিছু এখনো আমার কাছে খানিকটা দুর্বোধ্য মনে হতে থাকে। আমি অবিশ্যি সেটি নিয়ে মাথা ঘামালাম না। শিরান নামের মানুষটি সত্যি কথাই বলেছে, আমার মস্তিষ্কের আরেকটা কপি কোথাও থাকলেই কী আর না থাকলেই কী? আমি এখান থেকে বের হয়ে যাব–যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কিছুক্ষণের মাঝেই আমি মোটামুটিভাবে হাঁটতে শুরু করলাম। নিজের শরীরের ওপর খানিকটা নিয়ন্ত্রণ ফিরে এল। হঠাৎ করে মাথা ঘুরিয়ে তাকালে মাথাটা একটু ঘুরে ওঠে। এ ছাড়া অন্য কোনো উপসর্গ নেই। ক্লিশা বলেছে কিছুক্ষণের মাঝে এ সমস্যাটিও থাকবে না।
ঘণ্টাখানেকের মাঝে আমি আমার নিজের পোশাক পরে বের হয়ে এলাম। রাত্রিবেলা আমাকে যখন এখানে এনেছে তখন বুঝতে পারি নি, দিনের বেলা দেখতে পেলাম পুরো এলাকাটি খুব সুন্দর। পাহাড়ের পাদদেশে চমৎকার একটি হ্রদ, হ্রদের পানি আশ্চর্য রকম নীল–দেখে ছবির মতো মনে হয়। পুরো এলাকাটি গাছপালা দিয়ে ঘেরা, রাস্তাগুলো জনশূন্য। মাঝে মাঝে নিচু হয়ে একটি–দুটি বাইভার্বাল উড়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া কোনো যানবাহন নেই। সূর্যের নরম একটা উত্তাপ, হ্রদ থেকে হালকা শীতল বাতাস বইছে, বাতাসে এক ধরনের জলে ভেজা গন্ধ। আমি রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে থাকি, এলাকাটিতে এক ধরনের শান্তি শান্তি ভাব ছড়িয়ে আছে। এখানে কয়েকদিন থেকে গেলে মন্দ হয় না।
আমি বড় রাস্তা থেকে সরে গিয়ে গাছপালায় ঢাকা ছোট একটি রাস্তা ধরে খানিকটা উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে থাকি। রাস্তাটি সম্ভবত হ্রদের তীরে গিয়েছে, গাছের পাতা বাতাসে শিরশির করে নড়ছে–শব্দটি শুনতে বড় মধুর লাগতে থাকে। বড় বড় শহরগুলো থেকে গাছপালা পুরোপুরি উঠে গিয়েছে–এখানে এসে হঠাৎ করে এর গুরুত্বটুকু নতুন করে মনে পড়ল। রাস্তাটি সরু হয়ে আর ঘন গাছপালার ভেতরে চলে এসেছে, গাছের ওপর পাখি কিচিরমিচির করে ঝগড়া করছে, আরো উপরে নীল আকাশে সাদা মেঘ। সব মিলিয়ে পরিবেশটি ভারি মধুর।
অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে আমি হঠাৎ করে গাছপালার ভেতর থেকে বের হয়ে হ্রদের সামনে চলে এলাম। সামনে বিস্তৃত বালুবেলা সকালের নরম রোদে চিকচিক করছে। দূরে হ্রদের টলটলে পানি, পাহাড়ের ছায়া পড়ে পানিতে গাঢ় একটি নীল রঙ, দেখে মনে হয় বুঝি অতিপ্রাকৃত একটি দৃশ্য। এই অস্বাভাবিক সুন্দর দৃশ্যটি দেখে আমি কয়েক মুহূর্ত প্রায় নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। যখন বুকের ভেতর থেকে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিচ্ছি ঠিক তখন মনে হল একটি মেয়ের আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। এই অপূর্ব প্রায় অলৌকিক সুন্দর একটি জায়গায় মেয়ে কণ্ঠের আর্তচিৎকার এত অস্বাভাবিক মনে হল যে আমি ভয়ানক চমকে উঠলাম। মনে হল নিশ্চয়ই ভুল শুনেছি–কিন্তু ঠিক তখন আমি দ্বিতীয়বার একটি মেয়ের চিৎকার শুনতে পেলাম। এটি মনের ভুল নয়, সত্যি সত্যি কোনো একটি মেয়ে চিৎকার করেছে।
আমি মেয়েটির গলার আওয়াজ লক্ষ্য করে ছুটতে থাকি। হ্রদের তীরের টানা বাতাসে ছোটবড়া বালিয়াড়ি তৈরি হয়েছে। তার দুটি অতিক্রম করে তৃতীয়টির উপরে উঠতেই দেখতে পেলাম, বালিয়াড়ির অন্য পাশে কয়েকজন মানুষ মিলে একটি মেয়েকে টানাহ্যাঁচড়া করছে। আমি বালিয়াড়ির উপরে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বললাম, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে ওখানে?