একসময় সরীসৃপের মতো দেখতে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি বলল, আমার সিস্টেম প্রস্তুত। পুরোটি চার্জ করা হয়েছে।
লালচে চুলের অগোছালো চেহারার মানুষটি এক ধরনের বিরক্তির ভাব নিয়ে বলল, আমিও প্রস্তুত। ডাটা সারিবদ্ধ করা হয়েছে।
মহিলা বলে যাকে সন্দেহ করছিলাম সে প্রথমবার মুখ খুলল, চিকিৎসক রোবটটিকে বলল, কাজ রু কর, ইলেনা। তার কণ্ঠস্বর শুনে আমি এবারে নিঃসন্দেহ হলাম, মানুষটি আসলেই মহিলা।
আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, কিন্তু বুঝতে পারলাম রোবটটি আমার মাথার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমার মাথার পেছনে শীতল কিছু একটা স্পর্শ করল এবং হঠাৎ করে সেখানে প্রচণ্ড শক্তিতে কিছু আঘাত করল, আমি যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠলাম। হঠাৎ করে মনে হল আমার সমস্ত চেতনা বুঝি লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমি চেতনা হারালাম না, মাথার পেছন দিয়ে কিছু একটা আমার মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো শুরু করেছে। আমার দুটি হাত হঠাৎ করে আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সমস্ত শরীরে আমি অপ্রতিরোধ্য এক ধরনের খিচুনি অনুভব করতে শুরু করলাম। আমার চোখের সামনে পরিচিত জগৎ হঠাৎ করে কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যেতে লাগল। বিচিত্র কিছু নকশা, আশ্চর্য উজ্জ্বল কিছু রঙ চোখের সামনে খেলা করতে থাকে, সেগুলো নড়তে থাকে এবং মিলিয়ে যেতে থাকে, আমি উচ্চ কম্পনের কিছু শব্দ শুনতে থাকি এবং তার তীক্ষ্ণ ধ্বনি আমাকে অস্থির করে তোলে। হঠাৎ করে চারদিক নীরব হয়ে আসে, সেই ভয়ংকর নীরবতায় আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। আমি চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করি কিন্তু কিছুই দেখতে পাই না, মনে হয় চারদিকে কুচকুচে কালো অন্ধকার। আমি নিজের ভেতরে এক ধরনের গভীর বিষণ্ণতা অনুভব করতে থাকি, এক গভীর বিচিত্র হতাশা সমস্ত পৃথিবী, জগৎসংসার সৃষ্টি জগতের সবকিছুর প্রতি এক অতিমান এক ধরনের তীব্র দুঃখবোধে আমার বুকের ভেতর হাহাকার করতে থাকে। হঠাৎ করে আমার মনে হতে থাকে কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। আমি বেঁচে আছি না মরে গেছি। তাতেও কিছু আসে যায় না। এই জগৎসংসার, এই পৃথিবী, এই সৃষ্টি জগৎ বেঁচে আছে ধ্বংস হয়ে গেছে তাতেও কিছু আসে যায় না। আমি আমার সমস্ত চেতনাকে অদৃশ্য কোনো একটি অস্তিত্বের কাছে সমর্পণ করে গভীর এক ধরনের শূন্যতায় নিমজ্জিত হয়ে গেলাম।
০৩. রাজকুমারী রিয়া
আমি চোখ খুলে দেখতে পেলাম আমাকে ঘিরে তিনজন মানুষই দাঁড়িয়ে আছে। নিরানন্দ সরীসৃপের মতো মানুষটিকে হঠাৎ করে প্রাণবন্ত মানুষের মতো দেখাচ্ছে। লালচে চুলের বিরক্ত মানুষটিকেও কেমন জানি সহৃদয় মানুষ মনে হচ্ছে। যে মানুষটিকে পুরুষ না মহিলা বলে নিঃসন্দেহ হতে পারছিলাম না এখন হঠাৎ করে তাকে বেশ সুন্দরী একজন মহিলা মনে হল। নিশ্চয়ই আমার মস্তিষ্কে কিছু একটা করা হয়েছে যে কারণে গোমড়ামুখী নিরানন্দ তিনজন মানুষকেই হঠাৎ করে মোটামুটি সহৃদয় মানুষ বলে মনে হচ্ছে।
মহিলাটি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তোমার এখন কেমন লাগছে?
আমি মহিলাটির চোখের দিকে তাকালাম। মহিলাটির চোখে সত্যিকারের এক ধরনের উদ্বেগ। আমার জন্যে হঠাৎ করে এই মমত্ববোধ কেমন করে এল? আমি বললাম, জানি না।
নিরানন্দ মানুষটি বলল, জানার কথা নয়। বুঝতে একটু সময় লাগবে।
আমি মহিলাটির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে তাকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
আমার নাম রিকি।
তোমাকে আগে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুমি তোমার নাম বলতে চাও নি।
রিকি অন্য দুজনের দিকে তাকিয়ে শব্দ করে হাসল, হেসে বলল, আগে আর এখনের মাঝে একটা বড় পার্থক্য আছে।
কী পার্থক্য?
আগে তুমি ছিলে ট্রাকিওশান সরানো একজন ফালতু মানুষ শব্দটার জন্যে কিছু মনে করো না।
এখন?
এখন তোমার মস্তিষ্কে একটা ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস বসিয়ে তোমার পুরো নিউরাল কানেকশান ম্যাপ করে নিয়েছি–তুমি এখন ফালতু মানুষ নও। রীতিমতো গুরুত্বপূর্ণ মানুষ।
তার মানে আমার আর একটা অস্তিত্ব তৈরি করে নিয়েছ।
বলতে পার।
এটা বেআইনি। এটা তোমরা করতে পার না।
অন্য কারো বেলায় সেটা সত্যি তোমার জন্যে নয়। তুমি ভুলে যাচ্ছ শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি মানুষ হিসেবে তোমার সমস্ত অধিকার নিজে থেকে ছেড়ে দিয়েছ।
লাল চুলের মানুষটা সহৃদয় ভাবে হেসে বলল, তুমি ওসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। ট্রাইকিনিওয়াল বসিয়ে মস্তিষ্ক ম্যাপ করা হলে শরীরের ওপর খুব বড় অত্যাচার হয়।
আমি কিছু বললাম না।
তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে?
আমি উঠে বসার চেষ্টা করে বললাম, একটু দুর্বল লাগছে।
মহিলাটি আমাকে ধরে সোজা করে বসিয়ে দিয়ে বলল, হঠাৎ করে উঠে বোসো না। ধীরে ধীরে ওঠ।
আমি চারদিকে তাকালাম, সবকিছুই আগের মতো আছে তবুও কোথায় যেন সবকিছুকে একটু অন্যরকম দেখাচ্ছে। আমার মস্তিষ্কের মাঝে নিশ্চয়ই কিছু একটা পরিবর্তন করে দিয়েছে। আমি মাথার পেছনে হাত দিয়ে সেখানে ছোট একটা ধাতব টিউব অনুভব করলাম। জিজ্ঞেস করলাম, এটা কী?
ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস। ভেতরে ছোট ক্ষতটুকু শুকিয়ে গেলে খুলে নিতে পারবে।
আমার শরীর শিরশির করে ওঠে, মস্তিষ্কের সাথে সরাসরি সংযোগ করার জন্যে সেখানে একটি পোর্ট খুলে রেখেছে ব্যাপারটি চিন্তা করে আমার সারা শরীর গুলিয়ে ওঠে।