কোথায় জিজ্ঞেস করে কোনো লাভ হবে না বলে আমি কিছু জিজ্ঞেস করলাম না, নীরবে উঠে দাঁড়ালাম। আমি যখন ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম তখন অন্য মানুষগুলো এক ধরনের নিরুত্তাপ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
আমাকে একটি লম্বা করিডর ধরে হটিয়ে ছোট একটি কিউবিকেলে নেওয়া হল। সেখানে আমাকে নগ্ন হতে হল এবং আমি বুঝতে পারলাম এক ধরনের আঁজালো জীবাণুনাশক দিয়ে আমাকে পুরোপুরি জীবাণুমুক্ত করা হচ্ছে। আমার সমস্ত শরীরকে স্ক্যান। করা হল, নানা ধরনের যন্ত্রপাতি দিয়ে আমার শরীরের প্রায় প্রতিটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ঘুঁটিনাটি পরীক্ষা করা হল, জিনেটিকে কোডিং করে নেওয়া হল, মেটাবলিজমের হার নির্ধারণ করা হল এবং সবশেষে নিওপলিমারের একটি পোশাক পরিয়ে একটি বড় হলঘরে পৌঁছে দেওয়া। হল, সেখানে আমি প্রথমবার একজন সত্যিকারের মানুষ দেখতে পেলাম। মানুষটি একজন। কমবয়সী মেয়ে। তার সোনালি চুল এবং আকাশের মতো নীল চোখ। মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, আশা করছি তোমার কোনো অসুবিধে হয় নি।
আমি নিচু গলায় বললাম, হলেই সেটি নিয়ে কে মাথা ঘামাচ্ছে!
তোমাকে কী বলে ডাকব? তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–তোমার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না।
আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, কিছু জান না বলেই তো আমাকে এনেছ। কী করবে করে ফেল–শুধু শুধু নামপরিচয় জেনে কী হবে?
মেয়েটির চোখে–মুখে এক ধরনের বিস্ময়ের ছায়া পড়ল, এক মুহূর্ত ইতস্তত করে বলল, আমার নাম জানা। আমি এখানকার চিকিৎসা কেন্দ্রের দায়িত্বে আছি।
আমার নাম ভ্রাতুল। মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, এটা আমার সত্যিকারের নাম।
মেয়েটি সুন্দর করে হেসে বলল, সত্যিকারের নাম না হলেও আমি কখনো জানব না।
মেয়েটির কথাবার্তায় এক ধরনের সহৃদয়তার ছোঁয়া পেয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কেন এনেছ?
মেয়েটি একটু বিব্রত হয়ে বলল, আমি সত্যিই জানি না। মাঝে মাঝেই আমাকে কিছু মানুষকে পরীক্ষা করে তার শারীরিক অবস্থার একটা রিপোর্ট দিতে হয়। এর বেশি আমি কিছু জানি না। ক্রানা নামের মেয়েটি ইতস্তত করে থেমে গেল–মেয়েটি নিশ্চয়ই আরো কিছু জানে কিন্তু আমাকে বলতে চাইছে না।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, তুমি আমার সম্পর্কে কী রিপোর্ট দিয়েছ?
তুমি নীরোগ স্বাস্থ্যবান হাট্টাকাট্টা একজন যুবক।
এবং—
এবং কী?
এবং মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করে একটি ট্রাইকিনিওয়াল বসানো সম্ভব।
মেয়েটি আমার কথা শুনে ভয়ানকভাবে চমকে উঠল, অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তু–তু–তুমি কীভাবে জান?
জানি না। অনুমান করছি। আমাকে যেভাবে জীবাণুমুক্ত করা হল তাতে মনে হচ্ছে। সম্ভবত শরীরে কোনো অস্ত্রোপচার করা হবে। মাথার পেছনে মনে হচ্ছে খানিকটা জায়গায় একটু বেশি করে চুল কেটেছে। এরকম জায়গায় ট্রাইকিনিওয়াল বসায়। তাই অনুমান করছি।
মেয়েটি কিছু না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই আমাকে নিয়ে তোমরা যা। খুশি করতে পার। ভয়ংকর কোনো এক্সপেরিমেন্ট করার জন্যে আমার থেকে ভালো একজন মানুষ কোথায় পাবে? কারো কাছে কোনো দায়বদ্ধতা নেই–একেবারে নিখুঁত একটি গিনিপিগ।
মেয়েটি নিচু গলায় বলল, শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে তুমি খুব ভুল করেছ ভ্রাতুল।
আমি মাথা নাড়লাম, তুমি ঠিকই বলেছ জানা। কিন্তু সেজন্যে আমার কোনো দুঃখ নেই–আমি জেনেশুনেই এই ভুলটা করেছি।
ক্রানা আমাকে যে কয়েকজন মানুষের কাছে পৌঁছে দিল তাদের চেহারা কঠোর এবং আনন্দহীন। অপারেশন থিয়েটারের মতো নানা ধরনের যন্ত্রপাতি বোঝাই একটা ঘরের মাঝামাঝি একটি স্বচ্ছ ধাতব টেবিলে শুইয়ে আমার দুটি হাত এবং পা স্ক্র্যাপ দিয়ে বেঁধে ফেলল। এখানে আপত্তি বা প্রশ্ন করার মতো কোনো সুযোগ বা পরিবেশ নেই। একটা চিকিৎসক বরাবট আমার মাথাকে গোলাকার একটা টিউবে আটকে দেওয়ার সময় আমি মরিয়া হলে জিজ্ঞেস করলাম, তোমরা কী করছ?
আনন্দহীন চেহারার মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, একটু পরেই জানতে পারবে।
আমি মানুষটির চোখের দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বললাম তোমার নাম কী?।
আমার প্রশ্ন শুনে মানুষটি খুব অবাক হল। ভ্রূ কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, নাম? নাম দিয়ে তুমি কী করবে?
কৌতূহল।
কৌতূহল সংবরণ কর যুবক।
আমার নাম ত্রাতুল।
তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–কাজেই তোমার নাম ত্ৰাতুল না হয়ে কোলি ব্যাক্টেরিয়া হলেও কিছু আসে যায় না।
আমি নিচু গলায় বললাম, কিন্তু আমি একজন মানুষ।
মানুষ? হঠাৎ করে নিরানন্দ চেহারার মানুষটি আনন্দহীন গলায় হাসতে শুরু করল।
মানুষটির ভব্যতাবিবর্জিত পুরোপুরি হৃদয়হীন আচরণটিতে আমি হঠাৎ করে এক ধরনের আকর্ষণ খুঁজে পেতে শুরু করলাম। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচার করার জন্যে প্রস্তুতি নিতে শুরু করছিল আমি তখন ভেতরের মানুষগুলোকে তীক্ষ্ণ নজর দিয়ে পরীক্ষা করতে থাকি। হৃদয়হীন নিরানন্দ মানুষটির চেহারায় কোথায় যেন সরীসৃপের সাথে একটু মিল রয়েছে, হয়তো তার শীতল ভাবলেশহীন মুখ হয়তো উঁচু কণ্ঠার হাড় বা ফ্যাকাসে এবং বিবর্ণ মুখাবয়ব।
দ্বিতীয় মানুষটির অগোছালো চেহারা এবং চেহারার মাঝে এক ধরনের বিরক্তির ভাব পাকাপাকিভাবে লেগে আছে। মানুষুটির চুল লালচে এবং মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তৃতীয় মানুষটি সম্ভবত মহিলা কিন্তু তাকে দেখে সেটি নিশ্চিত হওয়ার কোনো উপায় নেই। চিকিৎসক রোবটটি যখন আমার মাথাটিকে বিশেষ গোলাকৃতি একটি হেলমেটের মতো যন্ত্রের মাঝে শক্ত করে আটকে ফেলার চেষ্টা করছিল তখন এই তিনজন মানুষ কয়েকটি ভিন্ন। ভিন্ন যন্ত্রের সামনে বসে কোনো একটি কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।