আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, সেটাই হয়তো সমাজের প্রতি আমার দায়িত্ব। অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত, ফালতু হয়ে বেঁচে থাকা–যেন আমাকে দেখে সমাজের অন্যরা সতর্ক হতে পারে। এই সৃষ্টি জগতে তেলাপোকারও একটা ভূমিকা আছে, তুমি জান?
পুরুষ মানুষটি ক্রুদ্ধ গলায় কিছু একটা বলতে চাইছিল কিন্তু মহিলাটি তাকে নিবৃত্ত করল। বলল, আহ্! কেন খামকা ঝামেলা বাড়াচ্ছ?
নিরাপত্তা বাহিনীর দুজন আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল।
বাইভার্বালটি একটা ছোট শহরের ওপর একবার পাক খেয়ে নিচে নেমে এল। একটা হ্রদ পার হয়ে ছোট একটা পাহাড়ের পাদদেশে পুরোনো একটা অট্টালিকার পাশে এসে এটি স্থির হয়ে দাঁড়াল। দরজা খোলা মাত্রই আমাকে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে নামানোর আগেই আমি নিচে নেমে এলাম। আমাকে সামনে এগিয়ে যেতে ইঙ্গিত করে প্রতিরক্ষা বাহিনীর দুজন সদস্য আমার পিছু পিছু হটতে থাকে। বাইরের একটা বড় দরজায় কিছু গোপন কোড এবং রেটিনা স্ক্যান করিয়ে আমাদের ভেতরে ঢোকানো হল। একটা ছোট করিডর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। সুইচ টিপে ভারী দরজা খোলা হল–ভেতরে নানা বয়সী কিছু মানুষ, চোখের দৃষ্টি দেখেই বোঝা যায় এদের সবাইকে ঠিক আমার মতো করে ধরে আনা হয়েছে। মানুষগুলো কৌতূহলী চোখে আমাদের দিকে তাকাল। আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, কিন্তু তার দরকার হল না।অত্যন্ত রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি আমাকে ঘরের ভেতরে ঠেলে দিপ্রায় সাথে সাথেই ঘরঘর করে ভারী দরজাটি বন্ধ হয়ে যায়।
ভেতরের মানুষগুলো আমাকে এবং আমি ভেতরের মানুষগুলো যাচাই করে দেখতে শুরু করলাম। ঘরের ভেতর সব মিলিয়ে সাতজন মানুষ–দুজন মেয়ে এবং পাঁচজন পুরুষ। দুটি মেয়েরই চোখের দৃষ্টি অপ্রকৃতিস্থ, দেখে বোঝা যায় ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে মস্তিষ্কের সর্বনাশ করে বসে আছে। দুজন পুরুষকে মনে হল পেশাজীবী অপরাধী, চোখে–মুখে একটু বেপরোয়া ভাব এবং হাতের আঙুলগুলো অদৃশ্য একটি লেজার রাস্টার১২ ধরে রাখার ভঙ্গি করে নড়ছে। অন্য মানুষগুলোকে মনে হল জীবন সম্পর্কে উদাসীন, একজনের মুখে একটু মৃদু হাসি এবং তাকে দেখে মনে হল পুরো ব্যাপারটি দেখে সে ভারি মজা পাচ্ছে। ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে অপ্রকৃতিস্থ হয়ে থাকা একটি মেয়ে ঘাড় বাকা করে একটা চোখ ঈষৎ খুলে বলল, তোমার কাছে কি বিভিচুরাস১৩ আছে?
বিডিচুরাসের মতো ভয়ংকর একটি মাদকদ্রব্য পকেটে নিয়ে কারো ঘোরার কথা নয়, কিন্তু মেয়েটি এই ধরনের সহজ যুক্তিতর্কের উপরে চলে গিয়েছে। ঈষৎ খুলে রাখা চোখটি বন্ধ করে অভিযোগ করার ভঙ্গি করে বলল, আমার স্টিমুলেটরটি নিয়ে গেছে।
পেশাজীবী অপরাধীদের একজন জিব দিয়ে চুকচুক শব্দ করে টিটকারি দিয়ে বলল, বড় অন্যায় করেছে!
মেয়েটি তার কথায় কোনো গুরুত্ব না দিয়ে বিড়বিড় করে অনেকটা নিজের সাথে কথা বলতে থাকে। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা মানুষটি তার মুখের মৃদু হাসিকে একটু বিস্তৃত করে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাকে কেন এনেছে?
আমি মাথা নেড়ে বললাম, জানি না।
তুমি কি কোনো অপরাধ করেছ?
এভাবে ধরে নিয়ে আসার মতো কোনো অপরাধ করি নি।
মানুষটি সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, তার মানে ছোটখাটো কিছু একটা করেছ।
তা করেছি। ট্রাকিওশানটা বের করে ফেলেছি।
উপস্থিত যারা ছিল তাদের প্রায় সবাই আমার দিকে ঘুরে তাকাল। পেশাদার অপরাধীর মতো মানুষটি অদৃশ্য লেজার ব্লাস্টারের ট্রিগার ছেড়ে দিয়ে আমার দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি ওস্তাদ মানুষ!
আমি তার কথায় কোনো উত্তর দিলাম না। মানুষটি তার ডান হাত দিয়ে গলায় পোচ দেবার ভঙ্গি করে বলল, কিন্তু ধরা পড়ে গেছ ওস্তাদ, এখন তুমি শেষ।
দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি বলল, তোমার শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটেকুটে নিয়ে নেবে।
কিংবা একটা বেকুব সাইবর্গ বানিয়ে ফেলবে।
কিংবা তোমাকে শীতল ঘরে নিয়ে রেখে দেবে। দ্বিতীয় পেশাদার অপরাধীটি দুলে দুলে হাসতে হাসতে বলল, হয়তো তোমাকে ভিনজগতের মহাকাশের প্রাণীর কাছে বিক্রি করে দেবে।
আমি এই অর্থহীন কথোপকথনে যোগ দিলাম না আমি নিশ্চিত বাইরে থেকে আমাদের প্রত্যেকটি কাজকর্ম, অঙ্গভঙ্গি খুব যত্ন করে লক্ষ করা হচ্ছে, ঠিক কী কারণ জানি না, আমার মনে হল এই দলটির মাঝে নিজেকে আলাদা করে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলায় বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি নীরবে এক কোনায় গিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মুখে মৃদু হাসি লেগে থাকা দার্শনিকের মতো মানুষষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার মন খারাপ করার কিছু নেই, এরা বেশ ভালো যত্ন করে। এখানকার খাবার খুব ভালো।
ভেতরে কতক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। একটা নির্দিষ্ট সময় পার হয়ে যাবার পর যখন হাল ছেড়ে দেওয়া হয় তখন হঠাৎ করে সময়ের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। আমাকে যখন ডেকে নেওয়া হল তখন আমি অপেক্ষা করতে করতে ঘুমিয়ে গিয়েছি–ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি যে আমি একটা বিশাল অরণ্যে হারিয়ে গেছি, যেদিকেই যাই সেদিকেই একটা বিশাল বৃক্ষ আমার পথ অবরোধ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার পোশাক ধরে খুব রূঢ়ভাবে ঝাঁকুনি দিয়ে আমাকে ঘুম থেকে তোলা হল, আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মানুষ বলল, চলো।