আমি জোর করে মুখে ভদ্রতার হাসি টেনে বললাম, ধন্যবাদ।
মানুষ দুজন বাইভার্বালে করে সরে যাবার পর আমি আবার হাঁটতে শুরু করি। পাতাল নগরীর কাছাকাছি একটি কৃত্রিম হ্রদ রয়েছে, তার তীরে একটা বিস্তৃত অংশে বনভূমি তৈরি করা হয়েছে। আমি সময় পেলে সেখানে গিয়ে হ্রদের বালুবেলায় ঘুরে বেড়াই–শহরের ঠিক মাঝখানে যেরকম উটকো বিপত্তির জন্ম হয় সেখানে সেরকম কিছু হওয়ার কথা নয়।
আমি অন্যমনস্কভাবে হাঁটতে হাঁটতে বড় বিল্ডিংটার অন্য পাশে চলে এসে পেছন দিকে তাকালাম। মাটি থেকে কয়েক মিটার উঁচুতে একটা বাইভার্বাল স্থির হয়ে আছে। আমি বড় রাস্তাটার অন্যপাশে এসে আবার পেছন দিকে তাকালাম, বাইভার্বালটি নিঃসন্দেহে আমাকে অনুসরণ করছে।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম। শরীরের ভেতর রক্তস্রোতে ঢুকিয়ে দেওয়া একটা ট্রাকিওশান দিয়ে একজন মানুষকে বহু দূর থেকে চোখে চোখে রাখা যায়–সেটি নেই বলে একটি আস্ত বাইভার্বাল এবং কয়েকজন মানুষ মিলে আমাকে চোখে চোখে রাখছে।
কারণটা কী বুঝতে পারছিলাম না বলে আমি নিজের ভেতর এক ধরনের অস্বস্তি অনুভব করতে থাকি।
০২. কিডন্যাপ
শহরতলিতে ছোট একটা রেস্টুরেন্টে আমি কিছু খেয়ে নিলাম–এখানে ভদ্র কিংবা সচ্ছল মানুষরা আসে না। যারা আসে তাদের সবাই সমাজের বাইরের মানুষ অনেকেই মাদকাসক্ত। একটা বড় অংশ আছে যারা ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টিমুলেটর ব্যবহার করে তাদের মস্তিষ্কে বড় ক্ষতি করে বসে আছে। অনেকেই চোখ ভালো করে খুলতে পারে না, হাত কিংবা পা নিয়ন্ত্রণের বাইরে কাঁপতে থাকে। কথা জড়িয়ে আসে। ভালো একটা চিকিৎসা কেন্দ্রে কিছু দক্ষ চিকিৎসক রোবট দিয়ে এদের অনেককেই সারিয়ে তোলা সম্ভব কিন্তু এই মানুষগুলোর সে ব্যাপারে উৎসাহ নেই। অনেকের ধারণা তা হলে জোর করে তাদেরকে সাইবর্গে পাল্টে দেওয়া হবে। কোনো মানুষ–তার যত সমস্যাই থাকুক কিছুতেই সাইবর্গ হতে চায় না।
রেস্টুরেন্টে নিরিবিলি খেয়ে আমি আমার শেষ সম্বলের কয়েকটি ইউনিট দিয়ে মূল্য পরিশোধ করে বের হয়ে এলাম। এই এলাকাটি সমাজবহির্ভূতদের এলাকা, চারদিকে আবছা অন্ধকার, আলোগুলো ভেঙে রাখা হয়েছে। আকাশের কাছাকাছি উত্তেজক পানীয়ের একটা বিজ্ঞাপন জ্বলছে এবং নিবছে, তার কিছু আলো এখানে ছড়িয়ে পড়েছে। দিনের বেলায় এই এলাকাটিকে অত্যন্ত নিরানন্দ এবং হতচ্ছাড়া দেখায় কিন্তু রাত্রিবেলায় আধো আলো এবং আধো অন্ধকারে এর মাঝে কেমন জানি এক ধরনের রহস্যের ছোঁয়া লেগেছে।
আমি রাস্তার পাশে উবু হয়ে বসে থাকা একজন মাদকাসক্ত মানুষকে পাশ কাটিয়ে কয়েক পা সামনে গিয়েছি, ঠিক তখন হঠাৎ করে একটি বাইভার্বাল নিঃশব্দে আমার পাশে নেমে এল। আমি কিছু বোঝার আগে তার গোলাকার দরজা খুলে যায় এবং এক জোড়া হাত আমাকে ধরে প্রায় হ্যাঁচকা টানে বাইভার্বালের ভেতরে ঢুকিয়ে নেয়। প্রায় সাথে সাথে বাইভার্বালটি শূন্যে উঠে যেতে থাকে, আমি তুরণের প্রকৃতি দেখে বুঝতে পারি এটি খুব দ্রুত সরে যেতে শুরু করেছে।
আমি নিজের জীর্ণ পোশাকটিকে সমান করার চেষ্টা করতে করতে বললাম, এর কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমাকে ডাকলে আমি স্বেচ্ছায় তোমাদের কাছে যেতাম।
বাইভার্বালের কন্ট্রোল প্যানেলে একটি নিরানন্দ সাইবর্গ বসে আছে, ভেতরে দুজন মানুষ। ভালো করে লক্ষ করলে বোঝা যায় দুজনের একজন পুরুষ অন্যজন মহিলা। এক সময় পুরুষ এবং মহিলার শারীরিক পার্থক্যটুকু খুব চড়া সুরে প্রকাশ করা হত–আজকাল খুব তীক্ষ্ণ চোখে পরীক্ষা না করলে সেটি ধরা যায় তার কারণ কী কে জানে। আজ থেকে এক শ বছর বা এক হাজার বছর পরে কীহলে পুরুষ এবং নারীর পার্থক্য কি ঘুচে যাবে, নাকি পুরুষ এবং নারী ছাড়াও অন্য ধরুন প্রজন্মের সৃষ্টি হবে?
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বাইভার্বালের জানালা দিয়ে নিচে তাকালাম, আলোকোজ্জ্বল একটা বড় শহরের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছি। আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে কে জানে। একজন মানুষের সাথে আরেকজন মানুষের যে সহজ সৌজন্যতা থাকা উচিত এদের মাঝে তা নেই। আমার সাথে কেউ একটি কথাও বলে নি, কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেবে কি কে জানে। তবুও আমি ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে তোমরা কোথায় নিয়ে যাবে?
মানুষ দুজন চুপ করে রইল, ভেবেছিলাম হয়তো উত্তরই দেবে না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী। ভেবে মহিলাটি কঠিন গলায় বলল, সেটা তুমি নিজেই দেখবে।
আমার বিনা অনুমতিতে আমাকে জোর করে ধরে নিয়ে আসা বেআইনি কাজ।
পুরুষ মানুষটি এবার কাঠকাঠ গলায় হেসে বলল, তোমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই। ইচ্ছে করলে তোমাকে আমি দরজা খুলে নিচে ফেলে দিতে পারি। কেউ কিছু জানবে না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, তুমি নিশ্চয়ই একটা এন্ড্রয়েড। কারণ একজন মানুষ কেউ জানবে না বলেই কখনোই আরেকজনকে খুন করে ফেলার কথা বলে না।
পুরুষ মানুষটি আমার কথা শুনে খুব ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল, আমার দিকে তার মাথাটা এগিয়ে এনে দাতে দাঁত ঘষে বলল, তুমি যদি একটা মানুষ হতে তা হলে এই কথা বলতাম না। তুমি হচ্ছ অকর্মণ্য, অপদার্থ, মাদকাসক্ত একজন ফালতু মানুষ। তুমি এই সমাজের কোনো কাজে আস না। তুমি দুপুরবেলায় নোংরা একটা ইঁদুরকে কোলে নিয়ে রাস্তায় পা ছাড়িয়ে বসে থাক।