ক্রানা হ্রদের উথাল–পাতাল বাতাসে তার উড়ন্ত চুলগুলো সামলানোর চেষ্টা করতে করতে বলল, আচ্ছা রিয়া এবং ত্রাতুল, তোমরা প্রতি বছর এখানে বেড়াতে আস কেন?
রিয়া আদুরে মেয়ের মতো আমার হাত জড়িয়ে ধরে রহস্য করে বলল, ব্যাপারটা গভীরভাবে রোমান্টিক! আমার সাথে ত্রাতুলের দেয়া হয়েছিল এখানে।
জিগি গলা উঁচিয়ে বলল, বাজে কথা বলে না। তোমার সাথে ত্রাতুলের দেখা হয়েছিল পরাবাস্তব জগতে। একটা যন্ত্রের ভেতরে তার মেমোরি সেলে। তোমরা সত্যিকার মানুষ পর্যন্ত ছিলে না!
রিয়া তীক্ষ্ণ চোখে জিগির দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে যে এই জগৎট সত্যি? তুমি সত্যি? তুমি কি বলতে পারবে যে তুমি এই মুহূর্তে অন্য কারো পরাবাস্তব জগতে বসে নেই?
জিগিকে খানিকটা বিভ্রান্ত দেখায়, সে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, না, তা অবিশ্যি পারব না–কিন্তু
রিয়া মুখে কপট গাম্ভীর্য এনে বলল, কাজেই তুমি বড় বড় কথা বলো না। আমাদের কাছে আমাদের সেই জগৎটাই ছিল বাস্তব। তুমি যেটুকু বাস্তব দেখেছ তার চাইতেও বেশি বাস্তব।
রিয়া একটি গভীর নিশ্বাস ফেলে বলল, সেই জায়গাটা ছিল এরকম। পাহাড়ের পাদদেশে নীল হ্রদ, দীর্ঘ বালুবেলা, বালুবেলার কাছে ঘন অরণ্য। তার সাথে হু–হুঁ করে। উথাল–পাতাল বাতাস। এখানে এলে আমাদের সেই জায়গাটার কথা মনে পড়ে তাই আমরা এখানে আসি।
জিগি হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গি করে মাথা নেড়ে বলল, আমি ভাবতেও পারি না। একজন মানুষ তার পরাবাস্তব জগতের স্মৃতি নিয়ে এরকম বাড়াবাড়ি করতে পারে!
ক্রানা বলল, মনে আছে প্রথমবার যখন পরাবাস্তব জগৎ থেকে ত্রাতুল আর রিয়ার মাথায় স্মৃতি ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল তখন কী হয়েছিল?
হ্যাঁ! জিগি চোখ বড় বড় করে বলল, স্মৃতি লোড করার আগে দুজন প্রায় অপরিচিত মানুষ। কিন্তু লোড করার পর চোখ খুলেই দুজন দুজনের কাছে ছুটে এসে একজন আরেকজনকে জড়িয়ে ধরে সে কী হাউমাউ করে কান্না!
আমি দুর্বল গলায় আপত্তি করার চেষ্টা করে বললাম, আমার যতদূর মনে আছে কান্নাকাটির অংশটি ছিল রিয়ার।
রিয়া একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ছিলই তো! তা আমি কী করব? জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে আমাকে এমনভাবে তৈরি করেছে যে অল্পতেই আমার চোখে পানি এসে যায়।
জিগি চোখ ঘুরিয়ে বলল, তোমার ভারি মজা রিয়া। কিছু একটা হলেই জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংকে দোষ দিতে পার। আমাদের বেলায় যাই করি না কেন পুরো দোষটা হয় আমাদের নিজেদের!
জিগির কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে, জিগির চতুর্দশ নম্বর বান্ধবী তার মাথায় একটা হালকা চাটি দিয়ে বলল, নিজেকে অন্যের সাথে তুলনা করো না জিগি। তোমার বেলায় সব দোষ যে আসলেই তোমার সেটা আমার থেকে ভালো করে কেউ জানে না।
এই সাধারণ কথাটি শুনেই আবার সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
.
সূর্য ডুবে যাবার পর আমি আর রিয়া বালুবেলায় হাঁটতে বের হলাম। আকাশে বড় একটা চাঁদ উঠেছে। তার ম্লান আলোতে দূরের পর্বতমালাকে কেমন জানি অপার্থিব দেখায়। সন্ধ্যাবেলার উথাল-পাতাল বাতাসে হ্রদের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে তীরে এসে আঘাত করছে। চারপাশে সুনসান নীরবতা, মনে হয় আমরা বুঝি কোনো একটি অতিপ্রাকৃত জগতে চলে এসেছি।
রিয়া আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে যেন আমাকে ছাড়লেই আমি অদৃশ্য হয়ে যাব। এই মেয়েটির সাথে পরিচয় না হলে আমি কখনোই সত্যিকার অর্থে ভালবাসা জিনিসটি কী সেটা বুঝতে পারতাম না। তার ভালবাসার ক্ষমতা এবং সেটা প্রকাশ করার ক্ষমতা দেখে আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই।
মাথার ওপর দিয়ে হঠাৎ করে একটা পাখি শব্দ করে ডেকে ডেকে উড়ে গেল, সেই ডাক শুনে কেমন জানি মন খারাপ হয়ে যায়। রিয়া একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে আছে ত্রাতুল?
কীসের কথা বলছ?
নুরিগার কথা।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, মনে নেই আবার?
আমি চোখের সামনে সেই দৃশ্যটি দেখতে পাই। পরাবাস্তব জগতে এরকম একটি বালুবেলায় নুরিগা আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছিল। আমরা তখন জেনে গেছি সত্যিকারের পৃথিবীতে দুটি সাইবর্গকে বাঁচাতে গিয়ে সত্যিকারের নুরিগা মারা গেছে, তার এখন পৃথিবীতে ফিরে যাবার কোনো উপায় নেই। পরাবাস্তব একটি জগতে সে চিরদিনের জন্যে আটকা পড়ে থাকবে। গভীর বেদনায় তার ভেতরটা নিশ্চয়ই দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছিল কিন্তু আমাদের সামনে সেটা প্রকাশ করল না। আমাদের দুজনকে আলিঙ্গন করে সে ফিসফিস করে বলেছিল, বিদায় ত্রাতুল। বিদায় রিয়া। পৃথিবীতে তোমাদের জীবন আনন্দময় হোক।
আমরা কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নুরিগা অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, আমার জন্যে তোমাদের ভালবাসার কথা আমার মনে থাকবে। তোমাদের সাথে দেখা না হলে আমি ভাবতাম সত্যিই বুঝি আমার জীবনের কোনো মূল্য নেই। সত্যিই বুঝি আমি তুচ্ছ। আমি অপরাধী।
রিয়া কোনো কথা না বলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। নুরিগা ফিসফিস করে বলেছিল, আমি কখনো ভাবি নি আমার জন্যে কেউ চোখের পানি ফেলবে। তুমি জান রিয়া, আজ আমার কোনো দুঃখ নেই?
তারপর নুরিগা হ্রদের বালুবেলায় বিষণ্ণ পদক্ষেপে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিল। আমরা দেখেছিলাম তার দীর্ঘ অবয়ব সন্ধ্যার অন্ধকারে দূরে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথায় আছে এখন সে? কেমন আছে?