প্রয়োজন নেই?
না।
কেন?
বাইরে সবাইকে বলতে হবে এখানে কী হচ্ছে।
ক্রানা শব্দ করে হেসে বলল, তার কোনো প্রয়োজন নেই।
কেন?
সারা পৃথিবীর সবাই এখন এটি জানে!
কেমন করে জানে?
এস আমার সাথে
ক্ৰানা আমাদের বড় একটি হলোগ্রাফিক স্ক্রিনের সামনে নিয়ে গিয়ে বলল, এই দেখ, সারা পৃথিবীতে একটু পরে পরে এই বুলেটিনটি প্রচারিত হচ্ছে।
আমরা রুদ্ধশ্বাসে তাকিয়ে রইলাম, হঠাৎ করে হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে একটি নারীমূর্তি স্পষ্ট হয়ে উঠল, আমরা অবাক হয়ে দেখলাম সেটি রিয়া। তার মুখে এক ধরনের ব্যাকুল ভাব, চোখে শঙ্কা। অনিশ্চিতভাবে সামনে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বলল, পৃথিবীর মানুষেরা, আমি পুরোপুরি নিশ্চিত নই তোমরা আমাকে দেখতে পাচ্ছ কি না, আমার কথা শুনতে পাচ্ছ কি না। আমার নাম রিয়া, পৃথিবীতে অনেকে আমাকে কৌতুক করে ডাকত রাজকুমারী রিয়া, কারণ আমাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা হয়েছিল–বলা হয়ে থাকে আমি হচ্ছি পৃথিবীর নিখুঁত মানবী–যদিও আমি সেটা বিশ্বাস করি না, কোনো মানুষ সবচেয়ে নিখুঁত হতে পারে না, তা হলে মানুষের ভেতরের শক্তিকে ক্ষুদ্র করে দেখা হয়।
আমার মনে হয় পৃথিবীর অনেক মানুষই আমার কথা শুনেছে, সেটা নিয়ে খানিকটা কৌতূহল এবং অনেক ক্ষেত্রে কৌতুক অনুভব করেছে। কিন্তু আজ আমি তোমাদের সামনে বলতে এসেছি যে এটি কৌতূহল বা কৌতুকের ব্যাপার নয়। এটি একটি ভয়ংকর ষড়যন্ত্রের ব্যাপার।
আমি নিশ্চিত তোমরা জান না আমাকে যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত হিসেবে তৈরি করা হয়েছে ঠিক সেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে বড় অপরাধী হিসেবে একজনকে সৃষ্টি করার চেষ্টা করা হয়েছে। কাজটি করা হয়েছে গোপনে। সেই মানুষটি কখনো কোনো অপরাধ করে নি কিন্তু তবুও তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করে শিকল দিয়ে বেঁধে খাঁচার মাঝে আটকে রাখা হয়েছে। পৃথিবীর ইতিহাসে এরকম নিষ্ঠুরতার কথা কেউ শুনেছে বলে আমার মনে হয় না। পৃথিবীর মানুষেরা, তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি–আমি নিশ্চিত শুনলে তোমরা আতঙ্কে শিউরে উঠবে।
আমাদের দুজনকে তৈরি করার পেছনে একটি কারণ রয়েছে। কারণটি বৈজ্ঞানিক কৌতূহল নয়। কারণটি বলা যায় এক কথায়, ব্যবসায়িক। আর সেই ব্যবসাটি হচ্ছে কোনো এক মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে। তারা পৃথিবীতে দেবে প্রযুক্তি তার বিনিময়ে পৃথিবী দেবে দুজন মানুষ। সবচেয়ে ভালো এবং সবচেয়ে খারাপ। একজন পুরুষ একজন মহিলা। আর এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে গোপনে। পৃথিবীর সকল মানুষের অজান্তে।
পৃথিবীর মানুষেরা–আমি জানি না, তোমরা আমার কথা শুনছ কি না। যদি শুনছ– আমি নিশ্চিত তোমরা নিশ্চয়ই ঘৃণা, আতঙ্ক এবং ক্রোধে শিউরে উঠছ। কিন্তু তোমরা এখনো পুরোটুকু শুনো নি।
এই যে আমাকে দেখছ, আমি কিন্তু সত্যিকারের রিয়া নই। সত্যিকারের রিয়া এখন কোথায় আছে আমি জানি না। সম্ভবত তাকে দূর কোনো এক গ্যালাক্সিতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ল্যাবরেটরিতে যেরকম করে গিনিপিগকে বিশ্লেষণ করা হত সেরকমভাবে বিশ্লেষণ করার জন্যে। আমি প্রকৃত রিয়ার একটি অস্তিত্ব। আমাকে একটা পরাবাস্তব জগতে তৈরি করা হয়েছে। আমার সাথে আরো অনেকে আছে। তারা আমাকে সাহায্য করেছে এই পরাবাস্তব জগৎটি দখল করে তোমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্যে।
পৃথিবীর মানুষেরা। শুধু তোমরাই পারবে এই নিঃসঙ্গ ভয়ংকর পরাবাস্তব জগৎ থেকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে। শুধু তোমরাই পারবে এই ভয়ংকর ষড়যন্ত্র রুখে দিতে। শুধু তোমরা। তোমাদের শুভবুদ্ধি আর তোমাদের ভালবাসা।
রিয়ার প্রতিচ্ছবিটি খুব ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল। আমি রিয়ার দিকে তাকালাম, তার চোখে পানি টলটল করছে, আমি নরম গলায় বললাম, খুব সুন্দর করে বলেছ রিয়া।
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমি বলি নি। ও বলেছে।
ও আর তুমি এক রিয়া। তোমরা এখন দুজন দু জায়গায় আছ কিন্তু আবার তোমরা এক হবে।
ঠিক এই সময় সমুদ্রের গর্জনের মতো এক ধরনের শব্দ শুনতে পেলাম। আমি অবাক হয়ে বললাম, এটি কীসের শব্দ?
ক্রানা বলল, মানুষের। হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মানুষ বাইরে এসে একত্র হচ্ছে। তারা সব ভেঙে ভেতরে ঢুকে পড়তে চাইছে।
সত্যি?
হা সত্যি।
ক্রানা রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, মানুষ খুব খেপে উঠছে, তোমাকে একটু বাইরে গিয়ে তাদের শান্ত করতে হবে। তুমি ছাড়া আর কেউ পারবে না। রাষ্ট্রপতি আসছেন, বিজ্ঞান একাডেমির সভাপতিও আসছেন। সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা চলে এসেছেন।
রিয়া অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল, ক্রানা হাত ধরে বলল, এস।
শেষ কথা
হ্রদের তীরে নৌকাটা পুরোপুরি থামার আগেই সবাই হৈ–হুঁল্লোড় করে নেমে এল। পানিতে ঝাপাঝাপি করে সবাই ভিজে গেছে কিন্তু কারো কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই মিলে ছুটি কাটাতে এসেছে–আজ এখানে কারণে–অকারণে আনন্দ এবং হাসির মেলা।
ক্রানা তার দুই বছরের বাচ্চাটিকে ধরে রেখেছিল, সে নামার জন্যে আঁকুপাকু করতে থাকে। তাকে নামিয়ে দিতেই সে থপথপ করে দুই পা এগিয়ে গিয়ে তাল সামলাতে না পেরে হমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। সেভাবেই সে হামাগুড়ি দিয়ে একটা লাল কাঁকড়ার কাছে এগিয়ে যায়। তাকে দেখে কাকড়াটি বালুর ভেতরে অদৃশ্য হয়ে গেল, শিশুটি তখন অবাক হয়ে চারদিকে দেখে, হাতের মুঠোর জিনিস যে হারিয়ে যেতে পারে এই অভিজ্ঞতাটুকু বুঝি এমন করেই মানুষের হয়।