এই দেখো–কানের নিচে একটা সুইচ আছে। দু সেকেন্ড চাপ দিয়ে ধরে রেখো, এরা চালু হয়ে যাবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই সবগুলো সাইবর্গ জেগে উঠে ছোটাছুটি শুরু করল। আমরা তাদেরকে লিফট দিয়ে উঠে যাবার নির্দেশ দিয়ে ছুটতে শুরু করি। করিডরের ভেতর দিয়ে ছুটে যাবার সময় হঠাৎ করে একটা করুণ আর্তনাদ শুনতে পেলাম। আমি থমকে দাঁড়িয়ে বললাম, সর্বনাশ!
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, কী হয়েছে।
এই হলঘরের ভেতরে আগুন লেগেছে। তোমাদের বাচানোর জন্যে যে কাজটা করেছি তাতে আর কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু–।
কিন্তু কী? ভেতরে দুজন আটকা পড়ে আছে। সাইবর্গের হোষ্ট। দুজন বুদ্ধিহীন মানুষ।
জিগি আমার দিকে আতঙ্কিত চোখে তাকাল। আমি কানার সিকিউরিটি কার্ড দিয়ে করিডরের দরজা খুলতেই হলঘরের ভেতর থেকে প্রচণ্ড গরম একটা আগুনের হলকা যেন আমাদের ঝলসে দিল। আমি সাবধানে ভেতরে তাকালাম, দূরে একটা চতুষ্কোণ যন্ত্রের পাশে দাঁড়িয়ে সাইবর্গ দুটি ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করছে, তাদের চারপাশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলছে। আমি চিৎকার করে হাত নেড়ে ডাকলাম, এস–এদিকে চলে এস।
বুদ্ধিহীন মানুষ দুজন আমার কথা শুনল কি না কিংবা শুনলেও বুঝতে পারল কি না জানি না। তারা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আতঙ্কে চিৎকার করতে লাগল। আমি আবার হাত নেড়ে ডাকলাম, আমার দেখাদেখি জিগি আর রিয়াও হাত নেড়ে ডাকতে লাগল কিন্তু কোনো লাভ হল না।
নুরিগা একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, ডেকে লাভ নেই।
তা হলে?
গিয়ে নিয়ে আসতে হবে। তোমরা দাঁড়াও আমি যাচ্ছি।
তুমি যাচ্ছ? আমি অবাক হয়ে বললাম, তুমি এর ভেতরে যাচ্ছ? তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে?
না। মাথা খারাপ হয় নি। কিন্তু কাউকে যদি ভেতরে যেতে হয় তা হলে কি আমারই যাওয়া উচিত না? কেউ যদি মারাই যায় তা হলে সবচেয়ে খারাপ মানুষটাই মারা যাক।
নুরিগার গলার স্বরে এক ধরনের জ্বালা ছিল সেটা আমাদের কানে স্পষ্ট ধরা পড়ল। আমি কিছু বলার আগেই রিয়া তার হাত স্পর্শ করে বলল, যে যাই বলুক, আমরা তোমাকে কখনো সবচেয়ে খারাপ মানুষ বলি নি।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, এসব নিয়ে পরে কথা বলা যাবে, ভেতরে দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমি যাচ্ছি।
আমাদেরকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে নুরিগা ছুটে ভেতরে ঢুকে গেল। আগুনের ভেতর দিয়ে ছুটে গিয়ে সে আতঙ্কিত দুজনকে ধরে টেনে নিয়ে আসতে থাকে। মানুষ দুটো তখনো কিছু বুঝতে পারছে না–একটানা চিৎকার করে যাচ্ছে। দরজার কাছাকাছি এসে একজনকে সে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়, দ্বিতীয় মানুষটা তার হাত থেকে নিজেকে ছুটিয়ে নিয়ে আবার ভেতরে ছুটে যাবার চেষ্টা করে। নুরিগা আবার তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে নিয়ে আসে। দরজার দিকে তাকে ঠেলে দিতেই হলঘরের ভেতরে প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। আগুনের একটা জ্বলন্ত গোলা ছুটে এসে হঠাৎ করে নুরিগাকে গ্রাস করে নেয়, আমরা হতবাক হয়ে দেখলাম প্রচণ্ড আগুনে নুরিগার সমস্ত শরীর দাউদাউ করে জ্বলছে। নুরিগা টলতে টলতে কোনোভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে চেষ্টা করে কিন্তু পারে না, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল, কোনোভাবে মাথা তুলে আমাদের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা বলার চেষ্টা করল কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই জ্বলন্ত একটি অগ্নিকূপ তাকে পুরোপুরি আড়াল করে ফেলল। চারদিকে শুধু আগুন আর আগুন। তার ভয়ংকর লেলিহান শিখা আর উত্তপ্ত বাতাসের হলকার মাঝে মনে হল আমরা শুনতে পেলাম নুরিগা চিৎকার করে বলছে, যাও! তোমরা যাও।
রিয়া দুই হাতে মুখ ঢেকে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে, কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি তার সুযোগ দিল না, বলল, পালাও, এক্ষুনি পালাও। পুরো এলাকাটি এক্ষুনি ধসে পড়বে।
আমি রিয়ার হাত ধরে টেনে ছুটতে থাকি। জিগি সাইবর্গ মানুষ দুটির হাত ধরে আমাদের পিছু পিছু ছুটতে থাকে। করিডরের শেষ মাথায় লিফটের ভেতরে ঢুকে সুইচ স্পর্শ করার সাথে সাথে পুরো এলাকাটা আরো একটি ভয়ংকর বিস্ফোরণে কেঁপে উঠল, ভয়ংকর আগুনের লেলিহান শিখা আমাদের দিকে ছুটে আসে কিন্তু তার আগেই লিফটটি উপরে উঠতে শুরু করেছে। জিগি ফিসফিস করে বলল, আমরা বেঁচে গেলাম।
এত নিশ্চিত হয়ো না। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, আমরা এখনো এই কেন্দ্রের ভেতরে আটকা পড়ে আছি। এটা উসের আস্তানা। লিফট থেকে বের হওয়া মাত্রই আমরা ধরা পড়ে যাব।
জিগি এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে আমার দিকে তাকাল। রিয়া কাঁপা গলায় বলল, কিন্তু আমরা সত্যি কথাটি সবাইকে জানিয়ে দেব।
কেমন করে জানাবে?
রিয়া হতবুদ্ধির মতো আমার দিকে তাকাল, আমি বললাম, সবাইকে জানাতে হলে আগে এখান থেকে বের হতে হবে। কেমন করে বের হবে?
কেউ নেই সাহায্য করার?
আছে। আমি মাথা নাড়লাম, তার নাম হচ্ছে ক্রানা। ক্ৰানা সাহায্য করেছে বলে আমরা এত দূর আসতে পেরেছি। যেভাবেই হোক আমাদের ক্রানাকে খুঁজে বের করতে হবে।
ঠিক এই সময় লিফট থেমে গেল। লিফটের দরজা নিঃশব্দে খুলে যেতেই দেখি ঠিক আমাদের সামনে জানা উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের দেখে কানার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, তোমরা বেঁচে আছ তা হলে
আমি ক্ৰানাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফিসফিস করে বললাম, আমাদের যেভাবে হোক বের হওয়ার একটা ব্যবস্থা করে দাও