রিয়া শক্তি বলয়ে আটকা পড়ে থেকে রক্তহীন ফ্যাকাসে মুখে ব্রাউসের দিকে তাকিয়ে রইল। খ্রাউস হাতের চৌকোনা কন্ট্রোল প্যানেলের একটা বড় সুইচ স্পর্শ করতেই তীক্ষ্ণ এলার্মের শব্দ বেজে ওঠে। দেয়ালে হঠাৎ করে কিছু সংখ্যা ফুটে ওঠে। সংখ্যাগুলো প্রতি সেকেন্ডে একটি করে কমে কাউন্ট ডাউন ক্ষ হয়ে যায়। খ্রাউস মুখের হাসিকে আরো বিস্তৃত করে বলল, আজ আমার খুব আনন্দের দিন। মহাজাগতিক প্রাণীদের আমি কথা দিয়েছিলাম, আমি আমার কথা রেখেছি! তারাও তাদের কথা রেখেছে, আমাকে দিয়েছে অসাধারণ সব প্রযুক্তি!
রিয়া চিৎকার করে বলল, তুমি এটা করতে পার না। পৃথিবীর মানুষ তোমাকে ক্ষমা করবে না। এটা অন্যায়, এটা বেআইনি।
তুমি সত্যিই বলেছ। এটা বেআইনি। এটা অন্যায় কি না জানি না, কিন্তু এটা বেআইনি। কাজেই এটা কারো জানার কথা নয়। তাই আমার কাজে সাহায্য করার জন্যে আমি সাইবর্গ তৈরি করেছি। অসংখ্য সাইবর্গ। কাজ শেষ হলে তাদেরকে আমি ব্যাক্টেরিয়ার মতো মেরে ফেলব। এই দেখ–তাদেরকে আমি এখানে অচল করে রেখে যাব। এদেরকে নিয়ে এই পুরো এলাকাটা ধ্বংস করে দেওয়া হবে।
খ্রাউস তার হাতের কন্ট্রোল প্যানেলের কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করতেই মহাকাশযানটিকে ঘিরে থাকা অসংখ্য সাইবর্গ পা ভেঙে একসাথে লুটিয়ে পড়ল। দুজন ছাড়া আমি এবং জিগি।
খ্রাউস সবিস্ময়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, সে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমি একটু এগিয়ে নিচে পড়ে থাকা একটা সাইবর্গের হাত থেকে একটা ভয়ংকর দর্শন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে উসের দিকে এগিয়ে গেলাম। নিচু গলায় বললাম, না খ্রাউস, তোমার যন্ত্র ঠিকই আছে। সেখানে কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা অন্য জায়গায়। আমরা সাইবর্গ নই।
আমি মাথা থেকে কপোট্রনিক ইন্টারফেস খুলে ফেলতেই খ্রাউস বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল। বলল, তোমরা?
হ্যাঁ।
খ্রাউস হঠাৎ পাগলের মতো হেসে উঠে বলল, তোমরা একটু দেরি করে ফেলেছ! এই দেখ পৃথিবীর মানুষ কীভাবে দূর গ্যালাক্সিতে পাড়ি দেয়–
আমি মাথা নাড়লাম। বললাম, দেবে না।
পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই যেটি এখন এই অভিযানকে থামাতে পারবে।
আছে।
খ্রাউস চিৎকার করে বলল, নেই।
তুমি নিজের চোখেই দেখো–
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে কাউন্ট ডাউন সংখ্যার দিকে তাকিয়ে রইল। এটি কমতে কমতে শূন্যতে এসে স্থির হতেই প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল। হঠাৎ করে সমস্ত জায়গাটা দুলে উঠল, তীব্র আলোর একটা ঝলকানি দেখতে পেলাম, শক্তি বলয় থেকে রিয়া এবং নুরিগা দুজন দুদিকে ছিটকে পড়ল। কর্কশ এক ধরনের এলার্ম বাজতে থাকে, আঁজালো পোড়া গন্ধ এবং ধোঁয়ায় হঠাৎ করে চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসে। খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল। দেখতে দেখতে সেই মুখ ভয়ংকর ক্রোধে হিংস্র হয়ে ওঠে, হঠাৎ করে সে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি হাতের অস্ত্রটি দিয়ে তাকে গুলি করার চেষ্টা করলাম কিন্তু সে আশ্চর্য ক্ষিপ্রতায় নিজেকে রক্ষা করে আমার টুটি চেপে ধরল। খাউসের শরীরে ভয়ংকর শক্তি–আমার মনে হল তার লোহার মতো হাত দিয়ে বুঝি আমার। ঘাড়টি একটি কাঠির মতো ভেঙে ফেলবে।
ঠিক তখন একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল এবং শক্তিশালী একটি অস্ত্রের গুলিতে খ্রাউসের পুরো মাথাটি উড়ে গেল। প্রায় সাথে সাথেই থ্রাউসের আঙুলগুলো আমার গলায় শিথিল হয়ে আসে। আমি নিজেকে কোনোভাবে মুক্ত করে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকি এবং তখন আমি একটা আর্তচিৎকার শুনতে পেলাম। মাথা ঘুরিয়ে দেখলাম রিয়া দুই হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে নিজের চিৎকার থামানোর চেষ্টা করছে। কী দেখে সে চিৎকার করছে আমি অনুমান করতে পারি, টলতে টলতে কোনোভাবে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে খ্রাউসের দেহের দিকে তাকালাম। গুলির আঘাতে তার মাথাটি উড়ে গিয়েছে, গলার শূন্য স্থান থেকে প্যাঁচপেচে সবুজ এক ধরনের তরল বের হচ্ছে, তার মাঝে কিলবিলে এক ধরনের প্রাণী। নুরিগা অস্ত্র হাতে হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, সে এইমাত্র গুলি করে খ্রাউসের মাথাটি উড়িয়ে দিয়েছে, কখনো কল্পনাও করে নি তারপর তাকে এই দৃশ্য দেখতে হবে।
আমি বুক ভরে নিশ্বাস নিতে গিয়ে খকখক করে কেশে ফেললাম। কোনোভাবে কাশি থামিয়ে বললাম, এত অবাক হবার কিছু নেই। খ্রাউস মানুষ নয়। মহাজাগতিক প্রাণীর ডিকয়।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, আমার আনন্দটি পুরো হল না। আমি মানুষটি ভালো নই– মাথার ঘিলু উড়িয়ে দিলে এক ধরনের আনন্দ পাই। এটি তো দেখছি মানুষ নয়–এর মাথাও নেই, ঘিলুও নেই।
রিয়া খ্রাউসের ভয়ংকর পরিণতি থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমাদের রক্ষা করার জন্যে তোমাদের অনেক ধন্যবাদ। আমার নাম রিয়া–
আমি জানি। আমি হেসে বললাম, আমার নাম ত্রাতুল। তোমার সাথে কথা বলেছিলাম মনে আছে?
রিয়ার চোখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ অবিশ্যি মনে আছে। রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু জিগি বাধা দিল, উত্তেজিত গলায় বলল, পাশের হলঘরে আগুন লেগে গেছে। আমাদের এক্ষুনি সরে পড়তে হবে। একটা একটা করে সাইবর্গকে চালু করে দাও। তাড়াতাড়ি। সবাই হাত লাগাও।
রিয়া জিজ্ঞেস করল, কেমন করে সাইবর্গ চালু করতে হয়?