কারণ আছে রিয়া।
কী কারণ–সেটাই আমি জানতে চাই।
খ্রাউস কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তার আগেই রিয়া ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তার আগে আমাকে আরো একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
কী প্রশ্ন?।
রিয়া খাঁচার ভেতরে আটকে থাকা নুরিগাকে দেখিয়ে বলল, এই মানুষটাকে তোমরা খাঁচার ভেতরে আটকে রেখেছ কেন? তোমরা বুঝতে পারছ না কাজটি কী ভয়ংকর অমানবিক?
খ্রাউস হা–হা করে হেসে বলল, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ কাজেই তোমার মানবিক অনুভূতিগুলো অন্য দশজন থেকে ভিন্ন। সবকিছুতেই অমানবিক কারণ খুঁজে পাও।
তুমি বলতে চাও এটা অমানবিক নয়? অন্য দশজনের বেলায়
এটা হয়তো অমানবিক কিন্তু এর বেলায় নয়।
কেন?
খ্রাউস উত্তর দেবার আগেই নুরিগা বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে উঠে বলল, কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
রিয়া অবাক হয়ে বলল, কী বললে? পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ?
হ্যাঁ। খুব একটা মজার কথা বলছে এরকম একটা ভঙ্গি করে নুরিগা বলল, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ থেকে জিন্সগুলো নিয়ে আমাকে তৈরি করেছে। তাই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
এটা কী ধরনের যুক্তি মানুষ খারাপ হয়ে যেতে পারে কিন্তু তার জিন্স কেমন করে খারাপ হয়? ছোট বাচ্চা বড় হলে কি তার জিন্স পাল্টে যায়? কখনো একটা ছোট শিশু দেখেছ যে অপরাধী? দেখেছ?
নুরিগা আবার হা–হা করে হেসে উঠে বলল, এটা তুমি ওদের বোঝাতে পারবে না।
রিয়া তীব্র দৃষ্টিতে ব্রাউসের দিকে তাকাল, কিন্তু খ্রাউস তার দৃষ্টিকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে বলল, চল, ওকে নিয়ে চল।
রিয়া ঝাঁকুনি দিয়ে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, তুমি এখনো বলে নি কেন আমাকে নিয়ে যাচ্ছ।
বলি নি, কারণ সেটা শুনলে হয়তো তোমার ভালো লাগবে না।
রিয়া খানিকক্ষণ নিঃশব্দে খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে থেকে কাঁপা গলায় বলল, তোমরা আমাকে আর নুরিগাকে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনো একটা অন্যায় কাজ করতে যাচ্ছ। অমানবিক কাজ করতে যাচ্ছ।
ন্যায়–অন্যায় মানবিক–অমানবিক খুব আপেক্ষিক ব্যাপার।
রিয়া ভয়ার্ত মুখে বলল, তার মানে তোমরা সত্যি সত্যি আমাদেরকে নিয়ে ভয়ংকর কিছু করছ।
খ্রাউস রিয়ার কথার উত্তর না দিয়ে সাইবর্গগুলোকে বলল, এদেরকে নিয়ে যাও ভেতরে।
রিয়া আরো কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু সাইবর্গগুলো তাকে সে সুযোগ দিল না– অত্যন্ত রূঢ়ভাবে তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিতে শুরু করল। আমার আবার ইচ্ছে করল রিয়ার কাছে ছুটে গিয়ে তাকে বলি, তোমার কোনো ভয় নেই রিয়া। আমরা তোমাকে রক্ষা করব–যেভাবে পারি রক্ষা করব। কিন্তু তাকে সেটা বলতে পারলাম না। সাইবর্গগুলোর পেছনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকলাম।
মহাকাশযানের ভেতরে যাবার আগে সবাইকে কোন ধরনের স্পেস সুট পরে নেবে বলে আমার একটা ধারণা ছিল কিন্তু দেখা গেল সেটি সত্যি নয়। সাইবর্গগুলো রিয়াকে তার আসনের কাছাকাছি দাঁড় করিয়ে সরে গেল, খ্রাউস কোথাও কোনো সুইচ স্পর্শ করতেই অদৃশ্য কোনো একটি শক্তির ক্ষেত্র নিচে নেমে এসে রিয়াকে আটকে ফেলল। রিয়া সেই অদৃশ্য ক্ষেত্রকে আঘাত করে কিন্তু সেটাকে ছিন্ন করতে পারে না। আমি শুনতে পেলাম সে কাতর গলায় চিৎকার করে বলছে, আমাকে এখান থেকে বের হতে দাও। তোমরা এভাবে আমাকে আটকে রাখতে পারবে না।
খ্রাউস রিয়ার কাতর চিৎকারকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে নুরিগাকে ভেতরে নিয়ে আসার জন্যে ইঙ্গিত করল। সাইবর্গগুলো তাদের যান্ত্রিক ক্ষিপ্রতায় নুরিগাকে ধাক্কা দিয়ে তার খাঁচাসহ ভেতরে নিয়ে গেল। তার জন্যে নির্দিষ্ট জায়গায় নুরিগাকে দাঁড় করিয়ে খ্রাউস কোথায় জানি স্পর্শ করতেই ওপর থেকে আবার এক অদৃশ্য শক্তি বলয় নিচে নেমে এসে নুরিগাকে তার ভেতরে আটকে ফেলল। খ্রাউস এবারে একটা সাইবর্গকে ইঙ্গিত দিতেই সে খাঁচার দরজা খুলে নুরিগাকে শক্তি বলয়ের মাঝে রেখে খাঁচাটা টেনে বের করে সরিয়ে নিল। মুরিগা পাথরের মতো মুখ করে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইল, শক্তি বলয়টি স্পর্শ করে দেখারও তার কোনো কৌতূহল নেই। খ্রাউস চাৰ্বদিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট হয়ে বলল, চমৎকার!
রিয়া এতক্ষণে নিজেকে খানিকটা সামলে নিয়েছে। হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে যে তার আর কিছু করার নেই। সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে বলল, তুমি এখন কী করবে?
খ্রাউস মহাকাশযানটির চারদিকে তাকিয়ে ভেতর থেকে বের হয়ে এল। হাতে একটা চতুষ্কোণ কন্ট্রোল প্যানেলের ওপরে সযত্নে হাত বুলিয়ে বলল, তোমরা নিজেরাই দেখবে। তবে মনে হয় এখন সময় হয়েছে তোমাদের বলে দেবার। খ্রাউস মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে গলায় খানিকটা নাটকীয়তা এনে বলল, পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ মানবী রিয়া এবং সর্বনিম্ন মানব নুরিগা তোমাদের দুজনকে অভিনন্দন। কারণ তোমরা পৃথিবীর প্রথম মানব সন্তান যারা মহাজাগতিক অভিযান করে দূর কোনো একটি গ্যালাক্সিতে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর জগতে যাচ্ছ।
রিয়া আর্তনাদ করে উঠল, চিৎকার করে বলল, না!
হ্যাঁ। খ্রাউসের মুখে একটা পরিতৃপ্তির হাসি ফুটে ওঠে, সে চোখ নাচিয়ে বলে, বুদ্ধিমান একটি মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে আমাদের যোগাযোগ হয়েছে। তারা আমাদের দিয়েছে নতুন নতুন প্রযুক্তি–তার বদলে আমরা তাদের দিচ্ছি দুটি পূর্ণাঙ্গ মানুষ। সবচেয়ে নিখুঁত এবং সবচেয়ে বড় অপরাধী।