সাইবর্গটা চিৎকার করে বলল, না, না–তুমি চুপ কর।
আকাশে তখন বিদ্যুৎ। বিদ্যুতের রঙ নীল।
আমার কথা শেষ হবার আগেই সাইবর্গটি হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল এবং আমি তখন কান্নার শব্দ শুনতে পেলাম। যন্ত্রের অংশটি অচল হবার পর নিশ্চয়ই তার ভেতরের মানুষটি কাঁদছে। একটি সাইবর্গের ভেতরের মানুষটি কি সব সময়ই এরকম বিষণ্ণ এবং হতাশাগ্রস্ত? আমি একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম তুমি কেন কাঁদছ?
আমাকে মুক্তি দাও। দোহাই তোমার
আমি তোমাকে কেমন করে মুক্তি দেব?
আমি কিছু একটা কথা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। আমাকে ঘিরে ছোট একটা ভিড় জমে উঠেছে। বেশ কয়েকটি রোবট, সাইবর্গ এবং এন্ড্রয়েড দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে কিছু মানুষও রয়েছে।
কঠোর চেহারার একটি এন্ড্রয়েড বলল, এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করেছে।
আরো একটি এন্ড্রয়েড তাদের অভ্যাসমতো বাড়াবাড়ি বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ। আমি নিজে শুনেছি।
নিরাপত্তা কেন্দ্রে খবর দিতে হবে।
কীভাবে খবর দেবে? তুমি দেখছ না এর শরীর থেকে কোনো সিগন্যাল আসছে না। এর শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই।
উপস্থিত সকল রোবট, সাইবর্গ, এন্ড্রয়েড এবং মানুষেরা বিস্ময়ের এক ধরনের শব্দ করল, আমি তখন বুঝতে পারলাম আমার এখান থেকে সরে পড়ার সময় হয়েছে। যদি। এভাবে বসে থাকি তা হলে কিছুক্ষণের মাঝেই আবার কিছু প্রতিরক্ষা রোবট নিয়ে নিরাপত্তা বাহিনী চলে আসবে। আমি উঠে দাঁড়ালাম এবং ঠিক তখন শুনতে পেলাম কাছাকাছি একটা বাইভার্বাল এসে দাঁড়িয়েছে এবং তার ভেতর থেকে দুজন প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ নেমে এসেছে। একজন গলা উঁচু করে বলল, এখানে এত ভিড় কেন? কোনো সমস্যা হয়েছে?
অন্য কেউ কিছু বলার আগেই আমি বললাম, না বিশেষ কিছু হয় নি। একটা সাইবর্গের সিস্টেম ফেল করেছিল, সেটি আবার তার সিস্টেম লোড করে নিচ্ছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি দাঁতের নিচে দিয়ে অস্পষ্ট গলায় সাইবর্গ প্রজাতির উদ্দেশে একটা কুৎসিত গালি উচ্চারণ করে বলল, সেজন্যে এত ভিড় করার কী আছে? সবাই নিজের কাজে যাও।
রোবট, সাইবর্গ আর এন্ড্রয়েডগুলো কোনো কথা না বলে সাথে সাথে বাধ্য মানুষের মতো সরে যেতে শুরু করল। মানুষদের একজন নিচু গলায় বলল, সাইবর্গটার সিস্টেম এমনি এমনি ফেল করে নি। এই মানুষটি মেটাকোড ব্যবহার করে ফেল করিয়েছে।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে আমার দিকে তাকাল, হঠাৎ করে তাদের ভুরু কুঞ্চিত হয়ে ওঠে এবং চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে। একজন মানুষ অনাবশ্যক রকম কঠিন গলায় বলল, সত্যি?
আমি মাথা নাড়লাম। কাজটি হালকাভাবে বেআইনি, বাড়াবাড়ি কিছু হওয়ার কথা নয়। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষটি তবুও তার মুখে মোটামুটি একটা ভয়ংকর ভাব ফুটিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন মেটাকোড ব্যবহার করেছ?
আমি মুখে একটা নির্দোষ সারল্যের ভাব ফুটিয়ে বললাম, সাইবর্গটা আমাকে বড় বিরক্ত করছিল।
বিরক্ত করলেই তুমি মেটাকোড ব্যবহার করবে? কোথা থেকে তুমি এই মেটাকোড পেয়েছ?
আমি হাসার ভঙ্গি করে বললাম, পাবলিক টয়লেটে লেখা থাকে। নেটওয়ার্কের কথা তো ছেড়েই দিলাম।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর লোকগুলো আরো কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগেই সাইবর্গটা নিজের পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, এই মানুষটার ট্রাকিওশান নেই।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো চমকে উঠে বলল, কী বললে?
বলেছি যে ট্রাকিওশান নেই।
মানুষ দুজন নিজেদের রনোগান বের করে আমার দিকে উঁচু করে কিছু একটা দেখে আবার শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বলল, সত্যিই নেই।
আমি একটা নিশ্বাস ফেললাম, বড় ধরনের অপরাধীরা শরীর থেকে ট্রাকিওশান সরিয়ে ফেলে, আমি বড় ধরনের দূরে থাকুক, ছোট অপরাধীও নই। কিন্তু এখন সেটা প্রমাণ করা যাবে না। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুটো এখন আমাকে ধরে নিয়ে যাবে, আমার জিনেটিক কোড দিয়ে আমার তথ্য বের করে তথ্যকেন্দ্র থেকে নিঃসন্দেহ হবে। যতক্ষণ আমার পরিচয় নিয়ে নিঃসন্দেহ না হচ্ছে ততক্ষণ আমার সাথে দুর্ব্যবহার করতে থাকবে। আমি একটি নিশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়ালাম–যেদিন নিজের ট্রাকিওশান ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি সেদিন থেকে এই বাড়তি ঝামেলার জন্যে মনে মনে প্রস্তুত হয়ে আছি।
প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষ দুজন কিন্তু হঠাৎ করে তাদের মুখের কঠোর ভাবটুকু ঝেড়ে ফেলে কেমন যেন সদয় চোখে তাকাল, তারপর সহজ গলায় বলল, ট্রাকিওশান খসিয়ে দিয়েছ?
আমি মাথা নাড়লাম। একজন চোখ মটকে বলল, ভালোই করেছ, এখন কোনো দায়দায়িত্ব নেই। ঝাড়া হাত–পা।
আমি মানুষটার চোখের দিকে তাকালাম, মনে হল সেখানে এক মুহূর্তের জন্যে একটা ধূর্ত দৃষ্টি উঁকি দিয়ে গেল। মানুষটি তখন উপস্থিত মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে জটলা না করে সবাই যে যার কাজে যাও। মানুষটা নিজের জীবনকে সহজ করার জন্যে ট্রাকিওশান পর্যন্ত খসিয়ে এসেছে অথচ তোমরা তাকে শুধু যন্ত্রণাই দিয়ে যাচ্ছ!
উপস্থিত মানুষগুলো এবং তার পিছু পিছু সাইবর্গটি সরে গেল, এখন এখানে আমি একা। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মানুষগুলো কী করে দেখার জন্যে আমি দাঁড়িয়ে রইলাম কিন্তু তারা কিছুই করল না। সহৃদয় ভঙ্গিতে একটু হেসে বলল, তোমার জীবন স্বাধীন হোক। শুভ হোক।