জিগি মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে দেখব না। শুধু গাণিতিক অংশটুকু উজ্জীবিত করা যায় বলে শুনেছিলাম–আজকে পরীক্ষা করে দেখলাম! সত্যিই যায়! জিগির অজান্তেই তার মুখ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
জিগির ধারণা সত্যি–খানিকক্ষণ আগে আমি কী হিসাব করেছিলাম, তার কিছু মনে নেই। জিগি লিখে রাখা হিসাবটুকু দেখে ক্যাবল সাজাতে থাকে। শক্ত মোটা ক্যাবল নাড়তে প্রায় মত্ত হস্তীর শক্তির প্রয়োজন, দুজনের একেবারে কালো ঘাম ছুটে গেল। নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের কয়েল করে তার মাঝখানে বিভিন্ন লোহার যন্ত্রপাতি এনে রাখা হল। কোনটা কোথায় রাখা হবে আমি একেবারে নিখুঁতভাবে বলে দিয়েছি। পুরোটুকু সাজিয়ে যখন শেষ করেছি তখন আমরা দুজনই ঘেমে–নেয়ে গিয়েছি।
দুজনে দেওয়ালে হেলান দিয়ে মুখ হাঁ করে নিশ্বাস নিতে থাকি। জিগি আমার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার! দেখি এখন মহাজাগতিক প্রাণী কেমন করে পৃথিবীর মানুষ নিয়ে পালিয়ে যায়!
আগেই এত উচ্ছ্বসিত হয়ো না জিগি। এখনো অনেক কাজ বাকি।
জিগিকে সেটা নিয়ে খুব বিচলিত্ত দেখা গেল না। এরকম সময়ে আমরা আমাদের পেছনে একটু শব্দ শুনতে পেলাম তাকিয়ে দেখি সাইবর্গ দুটো গুটিসুটি মেরে আমাদের পেছনে এসে বসেছে। তাদের চোখে একই সাথে এক ধরনের কৌতূহল এবং আতঙ্ক। আমাদেরকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।
আমি তাদের দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করলাম, কিন্তু সাইবর্গ দুটি আমার হাসি দেখে বিন্দুমাত্র আশ্বস্ত হল না, বরং এক ধরনের ভীতি তাদের ভেতর কাজ করল। উবু হয়ে অনেকটা পশুর মতো দুই হাত এবং এক পায়ে ভর দিয়ে আবার চৌকোনা একটা যন্ত্রের পেছনে লুকিয়ে গেল। জিগি হতাশভাবে মাথা নেড়ে বলল, মাথায় কপোট্রনের ইন্টারফেসটা লাগানো পর্যন্ত এরকমই থাকবে। কী একটা বাজে ব্যাপার।
মাথায় লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া যায় না?
নাহ্ আমরা ধরা পড়ে যেতে পারি। জিগি মাথা নাড়ল এবং হঠাৎ করে ঘুরে আমার দিকে তাকাল, একটা কাজ করলে কেমন হয়?
কী?
এই সাইবর্গ দুজনের কপোট্রনিক ইন্টারফেসটা যদি আমরা দুজন মাথায় পরে বের হয়ে যাই–তা হলে কেউ আমাদের সন্দেহ করবে না।
আমি ভুরু কুঁচকে জিগির দিকে তাকালাম, কী বললে?
আমরা দুজন মাথায় এই বাইবর্গের ইন্টারফেসটা পরে সাইবর্গ সেজে বের হয়ে যেতে পারি। বাইরে গিয়ে দেখতে পারি কী হচ্ছে।
কিন্তু ওরা বুঝে ফেলবে না?
না। সাইবর্গের মতো হাঁটব, চেষ্টা করব কোনো কথা না বলতে, আর যদি বলতেই হয় তা হলে সাইবর্গদের মতো কথা বলব।
আইডিয়াটা খারাপ না। এই হলঘরের ভেতরে এখন আর দেখার কিছুই নেই। করিডর ধরে হেঁটে গিয়ে মহাকাশযানটিকে হয়তো দেখতে পারি। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে বললাম, চলো তা হলে।
১৩. মুখোমুখি
আমি আর জিগি সাবধানে দরজা খুলে বের হয়ে এলাম। মাথার ওপরে কপোট্রনের ইন্টাফেসটা বসাতে বেশ কষ্ট হয়েছে। সত্যিকারের সাইবর্গের মাথার চুলগুলো ইলেকট্রোলাইসিস করে তুলে ফেলা হয়। করোটিতে ইন্টারফেসটা ক্রু দিয়ে আটকানো হয়–আমাদের সেরকম কিছু নেই বলে যে কোনো মুহূর্তে পুরোটা খুলে পড়ে যাবার একটা আশঙ্কা আছে। হাঁটতে হচ্ছে সাবধানে, এক হিসেবে ব্যাপারটি মন্দ নয় কারণ তার ফলে আমাদের দেখাচ্ছে সত্যিকারের সাইবর্গের মতো।
প্রথম কিছুক্ষণ আমরা ধরা পড়ে যাব সেরকম একটা আশঙ্কা আমাদের ভেতর কাজ করছিল। কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি বুঝে গেলাম কেউ কিছু সন্দেহ করছে না। আমরা চোখে–মুখে সাইবর্গীয় একটা উদভ্রান্ত দৃষ্টি ফুটিয়ে হেঁটে যেতে থাকি। করিডরের এক মাথায় একটি লিফট। অন্যপাশে বিচিত্র একটি মহাকাশযান, তার ভেতরে কিছু কাজকর্ম করা হচ্ছে। আমি আর জিগি কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম বড় একটি গোলাকার মঞ্চের মতো জায়গা, সেখানে পাশাপাশি দুটি আসন, আসনগুলো খালি যারা এখানে বসবে তারা এখনো এসে পৌঁছায় নি।
কিছুক্ষণের মাঝেই অবিশ্যি তারা পৌঁছে গেল। নুরিগাকে তার খাঁচার ভেতরে করে এনেছে, সে খাঁচার গারদগুলো ধরে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। নুরিগার পেছনেই একটি অপূর্ব সুন্দরী মেয়ে, তাকে দুপাশ থেকে দুটি শক্তিশালী সাইবর্গ ধরে রেখেছে। মেয়েটির চোখে–মুখে একটি বিচিত্র ধরনের আতঙ্ক, মনে হচ্ছে এখানে কী হচ্ছে সে বুঝতে পারছে না। এই মেয়েটি নিশ্চয়ই রিয়া–আমি তার সাথে কথা বলেছি। পরাবাস্তব জগতে আমার একটা অস্তিত্বের সাথে তার একটা অস্তিত্ব আটকা পড়ে আছে। হঠাৎ সম্পূর্ণ অপরিচিত এই মেয়েটির জন্যে আমি আমার বুকে গভীর মমতা অনুভব করলাম, আমার ইচ্ছে হল আমি তার কাছে ছুটে গিয়ে বলি, রিয়া তোমার কোনো ভয় নেই–আমরা তোমাকে রক্ষা করব।
কিন্তু আমি সেটা বলতে পারলাম না, রিয়ার ঠিক পেছনে খ্রাউস, তার আশপাশে অসংখ্য সাইবর্গ–তাদের অনেকে সশস্ত্র।
রিয়াকে দুই হাতে ধরে প্রায় টেনে নিয়ে যাচ্ছিল, তার মাঝে হঠাৎ করে সে থমকে দাঁড়িয়ে পেছনে ঘুরে তাকাল। খ্রাউসের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, এখানে কী হচ্ছে। আমাকে বলবে?
খ্রাউস শীতল গলায় বলল, বিশেষ কিছু নয়।
অবিশ্যি বিশেষ কিছু। তোমরা আমার কাছে খবর পাঠিয়েছ যে আমার মাথার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেসটা খুলে দেবে। আমি সব কাজ ফেলে ছুটে এসেছি। এখানে হাজির হওয়া মাত্র আমাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছ যেন আমি একটা খুনি আসামি। আমাকে এভাবে ধরে নিয়ে যাচ্ছ কেন?