আমি চোখ খুলে তাকালাম, মনে হল সমস্ত জগৎটাকে একটা ছোট ফোকাল লেংথের লেন্স দিয়ে দেখছি, চোখের সামনে সবকিছু নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘুরছে। আমি জিগিকে দেখতে পেলাম, সে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে আমাকে দুই হাত দিয়ে ধরে রেখেছে। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, ত্রাতুল, তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছ? তুমি আমাকে দেখতে পাচ্ছ?
আমি অনেক কষ্ট করে বললাম, পাচ্ছি।
চমৎকার। যা ভয় পেয়েছিলাম!
জিগি কেন ভয় পেয়েছিল কেন জানি সেটা জানার কৌতূহল হল না। কারণ হঠাৎ করে আমার মনে হতে লাগল খুব সহজেই পঞ্চম মাত্রার সমীকরণের একটা সমাধান বের করা যেতে পারে। সমীকরণের রাশিমালাগুলো যখন মস্তিষ্কে প্রায় সাজিয়ে ফেলেছি তখন শুনতে পেলাম জিগি জিজ্ঞেস করছে, দশমিকের পর পাইয়ের পঞ্চাশ নম্বর অংকটি কত?
কেন?
জানতে চাইছি–দেখি বলতে পারি কি না।
আমাকে হিসাব করে বলতে হল। রামানুজনের একটি সিরিজ ব্যবহার করে মস্তিষ্কের মাঝে হিসাব করে বললাম, শূন্য।
তার পরেরটি?
পাঁচ।
তার পরেরটি?
আট। আমি জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক হয়েছে?
কেমন করে বলব? আমি কি পাইয়ের মান কয়েক শ ঘর পর্যন্ত মুখস্থ করে রেখেছি নাকি?
তা হলে?
দেখছি তোমার মস্তিষ্ক হিসাব করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছে কি না।
আমি কিছু না বলে আবার আমার পাঁচ মাত্রার সমীকরণ দিয়ে যেতে চাইলাম কিন্তু জিগি বাধা দিল, সে জিজ্ঞেস করল, এখান থেকে লঞ্চ প্যাডটা দেখতে পাচ্ছ?
পাচ্ছি।
আয়তনটা অনুমান কর। কী দিয়ে তৈরি হতে পারে আন্দাজ করে ক্যাপাসিটেন্টটা বের কর।
আমি হিসাব করে বের করে বললাম, বেশ খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে।
থাকুক। জিগি আমার মাথাটা ঘুরিয়ে সুপার, কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটা দেখিয়ে বলল, এখন হিসাব করে বের কর ক্যাবলটা কেমন করে প্যাচাতে হবে, এর মাঝখানে কী ধরনের ফেরো ম্যাগনেট ব্যবহার করবে।
আমি হাত তুলে জিগিকে থামিয়ে দিলাম, হঠাৎ করে পুরো সমস্যাটা আমার কাছে একেবারে পানির মতো সহজ মনে হতে লাগল। আমি মস্তিষ্কের মাঝে ক্যাবলটা প্যাচানো শুরু করতেই শুধু যে চৌম্বকীয় ক্ষেত্রটা দেখতে শুরু করলাম তা নয়, সময়ের সাথে পরিবর্তনের হারটাও স্পষ্ট হয়ে উঠল। ঘরের মাঝে ছড়ানো–ছিটানো নানা লোহা এবং ইস্পাতের যন্ত্রগুলো মাঝখানে নিয়ে আসা হলে চৌম্বক ক্ষেত্রটা কত গুণ বেড়ে যাবে সেটাও হিসাব করে ফেললাম। শুধু তাই নয়, ঠিক কোথায় একটা মাঝারি আকারের লোহার পাত বসালে সেটা ছুটে এসে ক্যাবলটাকে আঘাত করে ভেতরের ক্রায়োজেনিক পাম্পটাকে অচল করে দিতে পারে সেটাও আমি অনুমান করে নিলাম। ঠিক কতক্ষণ সময়ে তরল হিলিয়াম বাষ্পীভূত হয়ে ঘরটার মাঝে একটা উচ্চচাপের সৃষ্টি করবে কিংবা কতটুকু অংশে সুপার কন্ডাক্টিভিটি নষ্ট হয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহের কারণে ক্যাবল উত্তপ্ত হয়ে আগুন ধরে যাবে এই ধরনের নানা বিষয় আমার মস্তিষ্কের মাঝে খেলা করতে লাগল।
জিগি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিল, এবারে তাগাদা দিয়ে বলল, বলো।
কী বলব?
হিসাব করে কী করলে?
সবকিছু বের করেছি।
আমাকে বলো।
আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, কেন তোমাকে বলব। আমার সব মনে আছে।
সেই জন্যেই বলছি। তোমার মস্তিষ্কটি এখন একটা নিউরাল কম্পিউটার, তুমি এখন সবকিছু মনে রাখতে পারছ। একটানে যখন ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস খুলে ফেলব, তখন কিছুই তোমার মনে থাকবে না।
আমার কাছে ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হল, এই সহজ জিনিসগুলো আমার মনে থাকবে কেন? জিগি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, দেরি করছ কেন? বলো। যদি না বলে তা হলে কিন্তু মহাবিপদ হয়ে যাবে।
পুরো ব্যাপারটাই আমার কাছে হাস্যকর এবং ছেলেমানুষি মনে হচ্ছিল কিন্তু তবুও আমি জিগিকে বলতে শুরু করলাম। জিগি দ্রুত সেগুলো লিখে নিতে রু করে।
আমি বুঝতে পারছিলাম আমি ঠিক প্রকৃতিস্থ নই, চোখের সামনে সবকিছুই কেমন জানি দুলছে, জিনিসগুলোর আকার–আকৃতিও ঠিক নেই। সবকিছুকেই কেমন জানি তুচ্ছ এবং অর্থহীন বলে মনে হতে থাকে। না চাইলেও মাথার ভেতরে জটিল সমীকরণ চলে আসতে থাকে এবং অবিশ্বাস্য দ্রুততায় আমি সেগুলো সমাধান করতে থাকি।
জিগি আমার কাছে এসে দাঁড়িয়ে কিছু একটা বলল, সে কী বলেছে আমি সেটাকে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে দ্রুত একটা চুয়াল্লিশ মাত্রার ম্যাট্রিক্স ওল্টানো শুরু করলাম। আমি টের পেলাম জিগি আমার মাথার পেছনে হাত দিয়েছে, কিছু একটা ধরে যাচকা টান দিতেই মাথার ভেতরে। একটা প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হল, মুহূর্তের জন্যে চোখের সামনে জগৎসংসার অন্ধকার হয়ে গেল।
আমি যখন জ্ঞান ফিরে পেলাম তখন জিগি আমার ওপরে ঝুঁকে আতঙ্কিত মুখে আমাকে ডাকছে। আমি চোখ খুলে তাকাতেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল, এন্ড্রোমিডার দোহাই! তা হলে চোখ খুলে তাকিয়েছ।
আমি চোখ এবং কপালে এক ধরনের ভোঁতা ব্যথা অনুভব করতে থাকি, কিন্তু সেটাকে উপেক্ষা করে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে বসলাম। জিগি আমাকে ধরে সাবধানে দাঁড় করিয়ে দাঁত বের করে হেসে বলল, চমৎকার! নিউরাল কম্পিউটারকে টার্বো মোডে চলানো যায় কি না। তাও পরীক্ষা করে দেখে ফেললাম!
কী দেখলে?
যায়।
দোহাই তোমার– আমি আমার মাথা দুই হাতে চেপে ধরে বললাম, ভবিষ্যতে আর কখনো এই পরীক্ষা করে দেখবে না।