কীভাবে হিসাব করবে?
জিগি দাঁত বের করে হেসে বলল, আমাদের একটা নিউরাল কম্পিউটার আছে। মনে নেই?
আমি চমকে উঠলাম, বললাম, তুমি আবার আমার মস্তিষ্ক ব্যবহার করতে চাইছ?
অবশ্যই! তা না হলে আমি নিউরাল কম্পিউটার কোথায় পাব?
অসম্ভব। আমি মুখ শক্ত করে বললাম, কখনোই নয়। তা ছাড়া তুমি সেই ইন্টারফেস আর সকেট কোথায় পাবে?
আগেরটা যেখান থেকে পেয়েছিলাম।
আগেরটা কোথা থেকে পেয়েছিলে? আমি ভেবেছিলাম তুমি নিজে তৈরি করেছ।
জিগি মাথা নাড়ল, আমি তৈরি করি নি–জুড়ে দিয়েছিলাম। মূল জিনিসটা পেয়েছিলাম একটা সাইবর্গের কপোট্রন থেকে। আমি নিশ্চিত আমরা ঠিক মেটাকোড বলে একটা সাইবর্গ ধরে আনতে পারব।
আমি হতবাক হয়ে জিগির দিকে তাকিয়ে রইলাম, সে কি সত্যি বলছে নাকি কৌতুক করছে বুঝতে পারছিলাম না–জিগির মুখে অবিশ্যি কৌতুকের কোনো চিহ্ন নেই। আমি কয়েকবার চেষ্টা করে বললাম, তুমি সত্যিই বলছ?
হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। এস তোমার সিকিউরিটি কার্ডটি নিয়ে।
খুব সাবধানে করিডরের দরজা অল্প একটু ফাঁক করে আমরা ভেতরে তাকালাম। দূরে গোলাকার মহাকাশযানটিকে দেখা যাচ্ছে, তার সামনে এক ধরনের ব্যস্ততা। অন্য পাশে লিফট থেকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি নামিয়ে আনা হচ্ছে। করিডর দিয়ে সাইবর্গরা হেঁটে যাচ্ছে–কোনো একটি বিশেষ কারণে এখানে কোনো মানুষ নেই।
আমরা হাইব্রিড দুই টাইপের দুটি সাইবর্গকে দেখতে পেয়ে দরজা ফাঁক করে হাতছানি দিয়ে ডাকলাম। সাইবর্গ দুটো কোনো রকম সন্দেহ না করে আমাদের দিকে এগিয়ে এল– ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি ম্যাজিকের মতো কাজ করছে।
আমরা তাদের হলঘরের ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিলাম। একটি সাইবর্গ ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তোমরা কে? কেন আমাদের ডেকেছ?
জিগি হাত নেড়ে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আমি সময় নষ্ট না করে সরাসরি মেটাকোডটি বললাম, কালো গহ্বরে এনিফর্মের নৃত্য।
আমার কথাটিতে ম্যাজিকের মতো কাজ হল, হঠাৎ করে দুটি সাইবর্গই পাথরের মতো স্থির হয়ে যায়, তাদের দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে এবং কপোট্রনের কোনো একটা অংশ থেকে একটা লাল আলো জ্বলে এক ধরনের ভোঁতা শব্দ করতে থাকে। জিগি সাইবর্গের কাছাকাছি গিয়ে তার মাথায় লাগানো নানা যন্ত্রপাতির ভেতরে কিছু একটা ধরে টানাটানি করতেই একটা অংশ খুলে আসে–সাইবর্গটির প্রকৃত মাথাটি বের হয়ে আসে, এটি চুলহীন ছোট প্রায় অপুষ্ট একটি মাথা। সাইবর্গটির কপোট্রনের নিয়ন্ত্রণ খুলে নেওয়ায় সেটি অসহায় হয়ে পড়ে, আমাদের দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাঁটু ভেঙে নিচে পড়ে বিকারগ্রস্তের মতো কাঁপতে শুরু করে।
আমি কাছে গিয়ে সাইবর্গটিকে সাহস দেওয়ার চেষ্টা করলাম। নরম গলায় বললাম, তোমার কোনো ভয় নেই। আমরা তোমার কোনো ক্ষতি করব না।
মাথা থেকে কপোট্রন খুলে নেওয়া অসহায় এবং আতঙ্কিত সাইবর্গটি হামাগুড়ি দিয়ে হলঘরের এক কোনায় পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করল। যন্ত্র দিয়ে তাকে চালিয়ে নেওয়া হয়, এই যন্ত্রের সহায়তাটুকু সরিয়ে নেওয়া হলে এটি একটি শিশু থেকেও অসহায়। ভীত একটি পশুর মতো সাইবর্গটি বড় একটি ধাতব চৌকোনা বাক্সের পেছনে নিজেকে লুকিয়ে ফেলল।
আমি এবারে দ্বিতীয় সাইবর্গটির দিকে তাকালাম এটি আমাদের প্রয়োজন নেই কিন্তু সম্ভবত তার কপোট্রন ইন্টারফেস খুলে রাখাটাই সবার জন্যে নিরাপদ। জিগি এগিয়ে তার মাথা থেকে ইন্টারফেসটি খুলে নেয়–এই সাইবর্গের প্রতিক্রিয়া হল আগেরটি থেকেও ভয়ংকর। সেটি মাথা কুটে আকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করল। আমি অনেক কষ্টে তাকে শান্ত করে আগের সাইবর্গটির পাশে বসিয়ে দিলাম। দুজন পর মতো জড়াজড়ি করে চৌকোনা বাক্সটির পেছনে মাথা নিচু করে লুকিয়ে রইল। মানুষের মস্তিষ্কের বড় ধরনের ক্ষতি করে দিয়ে তার সাথে যন্ত্রকে জুড়ে দিয়ে ব্যবহার করার এই অমানবিক প্রক্রিয়াটি একটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।
জিগি ইন্টারফেসটি খুলে সেখান থেকে কিছু তার বের করে আনে, যন্ত্রের নানা অংশে টেপাটিপি করে কিছু একটা পরীক্ষা করে বলল, জিনিসটা খুব উঁচুদরের হল না, কিন্তু কাজ করবে।
আমি শঙ্কিত হয়ে বললাম, উঁচুদরের হল না বলতে তুমি কী বোঝাতে চাইছ?
তথ্য আদান–প্রদানের ব্যাপারটা তোমার নিজেকেই করতে হবে।
তার মানে কী?
তুমি নিজেই বুঝবে। জিগি আমাকে ডাকল, এস। কাছে এস।
আমি জিগির কাছে এগিয়ে গেলাম। জিগি আমাকে একটা বড় যন্ত্রাংশের ওপর বসিয়ে দিল। আমার হাতে কিছু যন্ত্রপাতি ধরিয়ে দিয়ে সে আমার মাথার পেছনে গিয়ে কিছু একটা করতে থাকে, হঠাৎ করে মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল, চোখের সামনে বিচিত্র ধরনের আলোর বিচ্ছুরণ হতে থাকে, আমি কানের পাশে লক্ষকোটি ঝিঁঝি পোকার ডাক শুনতে থাকি। আমার সমস্ত শরীর পরিপূর্ণ অনিয়ন্ত্রিতভাবে কাঁপতে শুরু করে, মনে হয় কেউ আমাকে গলিত সীসার মাঝে ছুঁড়ে দিয়েছে।
কতক্ষণ এরকম ছিল জানি না, হঠাৎ মনে হল আমার সমস্ত শরীর হালকা হয়ে গেছে, আমি বাতাসের মাঝে ভাসছি। মনে হল বহু দূর থেকে কেউ একজন আমাকে ডাকছে, আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। গলার স্বরটি জিগির, সে আমাকে চোখ খুলে তাকাতে বলছে।