আমি ঘুরে চারদিকে তাকালাম, জায়গাটা একটা মঞ্চের পেছনের অংশের মতো– সামনে কী হচ্ছে পেছন থেকে কিছু বোঝার উপায় নেই।
আমি আর জিগি গোলাকার ঘরটির কাছে এগিয়ে গেলাম। দূর থেকে বোঝা যায় না কিন্তু কাছে এলে দেখা যায় এর দেওয়ালে বিচিত্র এক ধরনের নকশা, পৃথিবীতে কোথাও এরকম নকশা নেই, দেখেই মনে হয় এটি মানুষের হাতে তৈরি নয়। আমি হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই নকশাটি একটু সরে গেল, যেন এটি একটি জীবন্ত প্রাণী। আমি চমকে উঠলাম, দেওয়ালটি সরীসৃপের দেহের মতো শীতল। আমি হতচকিত হয়ে জিগির দিকে তাকালাম। জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে?
আমি এরকম একটা জিনিস পরাবাস্তব জগতে দেখেছি। খ্রাউস বলেছে এটা মহাজাগতিক প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেস।
নিজের অজান্তেই জিগি দুই পা পেছনে সরে এসে বলল, এটা মহাজাগতিক প্রাণীর ইন্টারফেস?
হ্যাঁ।
তার মানে তার মানে এটা একটা মহাকাশযান?
মহাকাশযান? মাটির তলায়? আমি চারদিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বললাম, এটা বের হবে কেমন করে? কোথাও তো বের হবার জায়গা নেই।
নিশ্চয়ই স্পেস টাইম কনটিনিউয়াম ভেদ করে যাবে, নিশ্চয়ই ওয়ার্মহোল তৈরি করে বের হয়ে যাবে। এই জন্যে এত বিশাল শক্তির দরকার। জিগির চোখ উত্তেজনায়। চকচক করতে থাকে, এখন বুঝতে পারছি কেন এই সুপার কন্ডাক্টিং ক্যাবল এখানে এসেছে।
আমি হঠাৎ করে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলাম, বললাম, মনে আছে খ্রাউস বলেছিল দুজনকে লঞ্চ প্যাডে নিয়ে যাও। নিশ্চয়ই এটাই সেই লঞ্চ প্যাড। এখান থেকেই মহাকাশযান উড়ে যাবে।
কিন্তু কোন দুজন?
আমার মনে হয় রিয়া আর নুরিগা। পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানবী আর পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানব।
জিগি মাথা নাড়ল, তারপর বলল, ঠিকই বলেছ, সেজন্যেই এখানে এত কাজকর্ম। হচ্ছে। লোকজন যাচ্ছে আসছে। সবকিছু প্রস্তুত করছে।
আমি একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিন্তু এটা তো কিছুতেই করতে দেওয়া যাবে। পৃথিবীর মানুষকে তো মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। কিছুতেই না।
তুমি কী করবে?
থামাব।
কীভাবে থামাবে?
আমি জানি না।
জিগি আমার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে ফেলল।
আমি এই বিশাল হলঘরটির দিকে তাকালাম, এটি মূল লঞ্চ প্যাডের আড়ালের অংশটুকু এখানে সচরাচর কেউ আসে না। যন্ত্রপাতিগুলো অবিন্যস্তভাবে ছড়ানো আছে। নানা ধরনের তার এবং ফাইবার ঝুলছে, মনিটর থেকে আলো বের হচ্ছে। বড় বড় ধাতব খণ্ড এখানে সেখানে ছড়ানো। ঘরের ঠিক মাঝামাঝি একটা অতিকায় ক্রেন দাঁড়িয়ে আছে, এই লঞ্চ প্যাড বসানোর সময় নিশ্চয়ই এটা ব্যবহার করা হয়েছে। এখানে মানুষজন আসে না বলে সত্যিকারের আলো নেই, বিভিন্ন যন্ত্রপাতি এবং মনিটরের আলোতে জায়গাটাতে এক ধরনের আলো–আঁধারি ভাব ছড়িয়ে আছে।
জিগি চারদিকে তাকিয়ে বলল, মহাকাশযানটিকে থামানোর একটি মাত্র উপায়।
সেটি কী?
এই জিগা–ওয়াট সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কেটে ফেলা, যেন মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় শক্তি না পায়।
আমি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বললাম, তোমার ছোট চাকুটা দিয়ে এই সুপার কন্ডাষ্টিং পাওয়ার ক্যাবলটি কাটতে পারবে বলে তো মনে হয় না।
না। জিগি মাথা নাড়ল, তুমি যে হাতের ধমনিটা কাটতে পেরেছিলে সেটাই বেশি।
আমি হলঘরটার চারদিকে তাকালাম, বললাম, এই ক্যাবলটা কাটার মতো সেরকম বড় আর ধারালো কোনো যন্ত্রপাতি এই ঘরে নেই?
থাকলেও লাভ নেই। ক্যাবলটা কাটলেই তারা বুঝতে পারবে সাথে সাথে তোমাকে ধরে ফেলবে।
আমি ক্যাবলটার দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ চমকে উঠে জিগির দিকে তাকালাম, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী হল?
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ!
মানে?
আমরা ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ ব্যবহার করে মহাকাশযান আটকে দিতে পারি!
ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ? তুমি নিশ্চয়ই জান ইলেকট্রনিক্স যে পর্যায়ে গিয়েছে তাতে গত হাজার বছরে ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণটি ব্যবহার করার প্রয়োজন হয় নি।
কিন্তু তাই বলে সমীকরণটি তো মিথ্যা হয়ে যায় নি।
তা যায় নি। কিন্তু তুমি কীভাবে এটা ব্যবহার করতে চাইছ?
খুব সহজ। এই ক্যাবলটা দিয়ে জিগা–ওয়াট শক্তি প্রবাহিত হবে এবং দেখাই যাচ্ছে সেটা বৈদ্যুতিক শক্তি। কাজেই এই ক্যাবলটাকে যদি আমরা একটা কয়েলের মতো পেঁচিয়ে তার মাঝখানে ফেরো ম্যাগনেট বসিয়ে রাখতে পারি তা হলে এটা একটা ইন্ডাক্টরের মতো কাজ করবে। তার মানে বুঝেছ?
জিগির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, বলল, বুঝেছি। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়াম ভেদ করার জন্যে একমুহূর্তের মাঝে অচিন্তনীয় পরিমাণ বিদ্যুৎ প্রবাহ হবে, সেই প্রবল প্রবাহ হঠাৎ করে ইন্ডাক্টরে আটকা পড়ে যাবে–যার অর্থ মহাকাশযানটি তার প্রয়োজনীয় বৈদ্যুতিক শক্তি পাবে। না!
হ্যাঁ। আমি মাথা নেড়ে বললাম, আমি নিশ্চিত শক্তির প্রয়োজনে একটু হেরফের হলেই এটা কাজ করবে না।
আমিও নিশ্চিত।
তা হলে কাজ শুরু করে দেওয়া যাক। দেখি ক্যাবলটাকে টেনে কতটুকু প্যাচাতে পারি।
দাঁড়াও। জিগি হঠাৎ আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, আমরা কাজটা আরো সুচারুভাবে করতে পারি।
কীভাবে?
যদি হিসাব করে নিই কী পরিমাণ ক্যাবলকে কতটুকু প্যাচাতে হবে, মাঝখানে কতটুকু ফেরো ম্যাগনেট রাখতে হবে, পাশে কতখানি রাখতে হবে, ক্যাপাসিটেন্স কত–