করিডরের দুই পাশে ছোট ছোট ঘর। কোথায় কী আছে জানা নেই, সিকিউরিটি কার্ডটি থাকার জন্যে সম্ভবত এর কোনো একটিতে আমরা লুকিয়ে পড়তে পারব। আমি সাবধানে একটি ঘর খুলে উঁকি দিলাম, ভেতরে কেউ নেই। আমি আর জিগি সাবধানে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আবার একটা লম্বা নিশ্বাস ফেললাম। এই ঘরটি ইলেকট্রিক্যাল পাওয়ার এবং ডাটা লাইনের একটা সংযোগ কেন্দ্র বিন্ডিংটির নানা অংশ থেকে নানা ধরনের। তার, ফাইবার এবং ক্যাবল এখানে এসে একত্র হয়ে চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কান পেতে থাকলে এখানে স্বল্প কম্পনের চাপা একটি গুঞ্জন ধ্বনি শোনা যায়।
আমি মাকড়সার জালের মতো ছড়ানো–ছিটানো তার, ফাইবার এবং ক্যাবল থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ঘরের অন্যান্য যন্ত্রপাতি লক্ষ করছিলাম তখন হঠাৎ করে জিগির বিস্ময়ধ্বনি শুনতে পেলাম, ওরে সর্বনাশ!
আমি জিগির দিকে ঘুরে তাকালাম, কী হয়েছে?
জিগি হাত দিয়ে কালো রঙের মোটা একটি ক্যাবল দেখিয়ে বলল, এই দেখ।
এটা কী?
পাওয়ার ক্যাবল। সুপার কন্ডাক্টিং পাওয়ার ক্যাবল, জিগা–ওয়াট২২ পাওয়ার নেওয়ার ব্যবস্থা।
জিগা–ওয়াট? আমি অবাক হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি? এই ছোট বিল্ডিঙের মাঝে জিগা–ওয়াট পাওয়ার ক্যাবল?
হ্যাঁ।
কেন?
সেটা আমারও প্রশ্ন। জিগি ভুরু কুঁচকে চিন্তা করার চেষ্টা করে বলল, এটা অসম্ভব। এই বিল্ডিঙের যে পরিমাণ শক্তি দরকার তার জন্যে এত পাওয়ার লাগার কোনো কারণ নেই। তুমি জান সুপার কষ্টিং পাওয়ার ক্যাবল তৈরি করতে কী পরিমাণ যন্ত্রণা?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, জানি।
শুধুমাত্র লিকুইড হিলিয়াম সাপ্লাই চালু রাখতেই বারোটা বেজে যায়। অন্য ব্যাপার তো ছেড়েই দাও।
তা হলে এটা এখানে কেন আছে?
জিগি তার পোশাকের ঝুলে থাকা অংশগুলো ট্রাউজারের ভেতর খুঁজে নিয়ে বলল, চলো বের করে ফেলি।
বের করে ফেলবে?
হ্যাঁ। করিডর দিয়ে হাঁটাহাঁটি করলে এমনিতেই ধরা পড়ার ভয়। তার চাইতে ধরো এই পাওয়ার ক্যাবল ধরে ঝুলতে ঝুলতে যাই।
জিগি ঠাট্টা করছে না সত্যি বলছে বুঝতে আমার একটু দেরি হল–আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম সে ঠাট্টা করছে না সত্যিই বলছে। আমি ইতস্তত করে বললাম, কাজটা খুব সহজ হবে?
মনে হয় না। কিন্তু সেটা কি বিবেচনার একটি বিষয়?
আমি মাথা নাড়লাম, জিগি ঠিকই বলেছে, এটি বিবেচনার বিষয় নয়। গত দুএকদিনে আমরা যা যা করেছি তার তুলনায় এটা বিবেচনার কোনো বিষয়ই নয়।
পাওয়ার ক্যাবলটি মোটা, সাপের মতো এঁকেবেঁকে গিয়েছে, স্পর্শ করলে ক্রায়োজেনিক পাম্পের কম্পন অনুভব করা যায়। আমি আর জিগি ক্যাবলটির ওপর দিয়ে হেঁটে, কখনো এটা ধরে ঝুলে ঝুলে, কখনো সরীসৃপের মতো পিছলে পিছলে অগ্রসর হতে থাকি। মাঝে মাঝে আরো নানা ধরনের তার, ক্যাবল এবং ফাইবার এটার ওপর দিয়ে চলে গিয়েছে। কিছু। কিছু রীতিমতো বিপজ্জনক, খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়। ক্যাবলটি সোজা এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ করে নিচে নামতে লাগল, জিগি অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! দেখো এটা কত নিচে নেমে গেছে।
আমিও অবাক হয়ে দেখলাম সত্যি সত্যি পাওয়ার ক্যাবলটি প্রায় অতল পাতালে নেমে গিয়েছে। এত প্রচণ্ড শক্তি নিচে কোথায় নেমে গিয়েছে চিন্তা করে এবারে আমরা সত্যি। কৌতূহলী হয়ে উঠি।
ক্যাবলটি বেয়ে বেয়ে নিচে নামা সহজ নয়, হাত ফসকে গেলে নিচে কোথায় গিয়ে পড়ব জানা নেই, কিন্তু এখন আর এত ভাবনাচিন্তার সময় নেই। দুজনে ক্যাবলটি জাপটে ধরে সরসর করে নিচে নামতে থাকি। এদিক দিয়ে কখনো মানুষ যায় না, বাতাসের প্রবাহ অপর্যাপ্ত এবং দূষিত। কিছুক্ষণেই আমরা কালিঝুলি মেখে ধুলায় ধূসরিত হয়ে গেলাম। নিচে নামতে নামতে যখন মনে হচ্ছিল হাতে আর শক্তি নেই আর একমুহূর্তও ঝুলে থাকতে পারব না, তখন দুজনে ঝুপঝুপ করে নিচে নেমে এলাম।
জায়গাটি একটি বড় হলঘরের মতো, চারদিকে নানা ধরনের যন্ত্রপাতি ছড়ানো। হলঘরের মাঝখানে গোলাকার একটা শক্ত কংক্রিটের ঘর। আমরা যে ক্যাবলটি বেয়ে নেমে এসেছি সেটা এই ঘরের ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে, তুলনামূলকভাবে ছোট একটি ঘরের মাঝে এই বিশাল পরিমাণ শক্তি কেমন করে ব্যবহার করা হচ্ছে আমরা বুঝতে পারলাম না।
আমি আর জিগি সাবধানে গোলাকার ঘরটি ঘুরে এলাম, এক পাশে উঁচু টিউবের মতো ছোট একটা করিডর, এর কাছাকাছি একটা লিফট নেমে এসেছে। আমরা যে জায়গাটিতে আছি সেটি মূল অংশের পেছনের সার্ভিস এরিয়া, মানুষজন আসে না। লিফট দিয়ে নেমে এই টিউবের মতো করিডর ধরে লোকজন মাঝখানের গোলাকার অংশটিতে ঢুকতে পারে। লিফট থেকে চাপা গুম গুম শব্দ শুনে বুঝতে পারছি সেটা উপরে উঠছে এবং নিচে নামছে, সম্ভবত লোকজন আসছে এবং যাচ্ছে। আমরা করিডর ধরে হেঁটে একটা দরজা পেলাম, ইচ্ছে করলে এটা খুলে করিডরের ভেতরে যেতে পারি কিন্তু এই মুহূর্তে সেখানে লোকজনের যাতায়াতের শব্দ শোনা যাচ্ছে, কাজেই ভেতরে ঢোকা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।
আমরা আবার গোলাকার ঘরটির কাছে ফিরে এলাম, জিগির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী আছে এই ঘরটায়?
জিগি মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। পরিচিত কিছু নয়, এত ছোট জায়গায় এত শক্তির প্রয়োজন হয় সেরকম কিছু আমার জানা নেই।