খ্রাউস হিংস্র চোখে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী খবর?
রক্তের রঙ লাল। একটু থেমে বললাম, সবুজ নয়!
খ্রাউস বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, কী বললে?
বলেছি রক্তের রঙ লাল–সবুজ নয়।
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল খ্রাউস বুঝি আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল না, দরজাটা সশব্দে বন্ধ করে বের হয়ে গেল। জিগি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হচ্ছে এখানে? আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমার হঠাৎ এক ধরনের ক্লান্তি লাগতে থাকে। পিছিয়ে এসে দেওয়ালে হেলান দিয়ে বসে আমি জিগির দিকে তাকিয়ে বললাম, মনে আছে একটু আগে তুমি আমাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠিয়েছিলে?
হ্যাঁ। মনে আছে।
সেখানে আমি খ্রাউসকে খুন করার জন্যে একটা ধাতব দণ্ড দিয়ে আঘাত করেছিলাম। আঘাতে কানের নিচে ফেটে গিয়ে রক্ত বের হয়ে এসেছিল।
জিগি অবাক হয়ে বলল, তুমি–তু–তুমি আঘাত করেছিলে? খ্রাউসকে?
হ্যাঁ। আমি নিশ্বাস ফেলে বললাম, আঘাত করাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। মানুষ হঠাৎ করে রেগে গেলে তো একজন আরেকজনকে আঘাত করতেই পারে। যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে–
সেটা হচ্ছে?
খ্রাউসের কানের নিচে কেটে যে রক্ত বের হয়েছিল সেটা। সেই রক্তের রঙ ছিল সবুজ।
জিগি চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ।
অসম্ভব। এটা হতে পারে না।
এটা হয়েছে। আমি জানি।
জিগি আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, এর অর্থ কী?
আমার ধারণা খ্রাউস মানুষ নয়।
মানুষ নয়?
না। আমি মাথা নাড়লাম। খ্রাউস এন্ড্রয়েড, সাইবর্গ বা রোবটও নয়। খ্রাউস হচ্ছে। একটা ডিকয়।
ডিকয়?
হ্যাঁ। আমাদের পৃথিবীর প্রযুক্তি পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করার জন্যে এখনো প্রস্তুত হয় নি। কিন্তু দেখতেই পাচ্ছ এখানে সেই প্রযুক্তি আছে। কারণ কোনো এক মহাজাগতিক প্রাণী সেই প্রযুক্তি পাঠিয়েছে। পৃথিবীর মানুষের সাথে যোগাযোগ করেছে যে ইন্টারফেস সেটাই হচ্ছে খ্রাউস। খ্রাউস হচ্ছে সেই ডিকয়। মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়। তাই রক্ত সবুজ।
যারা এত কিছু করতে পারে তারা রক্তের রঙ লাল করতে পারে না?
নিশ্চয়ই পারে। কিন্তু আমি যে খ্রাউসকে দেখেছি সে ছিল পরাবাস্তব জগতে। সেখানে আমার কিংবা আর কারো যাবার কথা ছিল না। সেজন্যে মাথা ঘামায় নি। সেখানে আমি শুধু উসকে দেখি নি–আরো অনেক বিচিত্র জিনিস দেখেছি। যার অনেক কিছু সম্ভবত মহাজাগতিক
কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ। তোমাকে বলার সুযোগ পাই নি।
আমি দেওয়ালে মাথা রাখলাম, হঠাৎ করে আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করি। কোনো কিছু করতে না পারা থেকে এক ধরনের অসহায় ক্রোধ। সেই ক্রোধ থেকে ক্লান্তি। জিগি আমার ওপর ঝুঁকে পড়ে বলল, তোমাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছে।
হ্যাঁ। হঠাৎ করে দুর্বল লাগছে।
ডাক্তার মেয়েটি তোমাকে বলকারক একটা ওষুধ দিয়ে গেছে তুমি খাও।
আমি জিগির দিকে তাকিয়ে হাসার চেষ্টা করে বললাম, শরীরে বল বাড়িয়ে কী হবে? খ্রাউস এই মুহূর্তে পরিকল্পনা করছে কীভাবে আমাদের নিশ্চিহ্ন করবে।
করুক। জিগি কানার দিয়ে যাওয়া প্যাকেটের ভেতরে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলল, কোথায়? এখানে কোনো ওষুধ নেই। একটা কার্ড।
কার্ড?
আমি চমকে সোজা হয়ে বললাম, কী কার্ড?
ক্রানার সিকিউরিটি কার্ড!।
মুহূর্তে আমার শরীর থেকে সকল দুর্বলতা উধাও হয়ে গেল। আমি সমস্ত স্নায়ুতে এক ধরনের তীব্র উত্তেজনা অনুভব করলাম। কানা আসলে আমাকে বিশ্বাস করেছে, তার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সে আমাকে তার সিকিউরিটি কার্ডটি দিয়েছে, তার মানে আমাদের সামনে এখনো একটি সুযোগ রয়েছে। আমার শরীরে এড্রেনেলিনের প্রবাহ শুরু হয়ে গেল। আমি লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জিগিকে বললাম, চলল।
কোথায়, কেন, কীভাবে, কখন এসব নিয়ে জিগি এতটুকু মাথা ঘামাল না, সেও লাফিয়ে উঠে বলল, চলো।
১২. ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণ
ঘর থেকে খুব সাবধানে আমি মাথা বের করলাম। দীর্ঘ করিডরে কেউ নেই। আমি হাত দিয়ে জিগিকে ইঙ্গিত করতেই সে আমার পিছু পিছু বের হয়ে এল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ড ব্যবহার করে বন্ধ ঘরের ভেতর থেকে বের হয়ে এসেছি, কাজেই কোথাও কোনো এলার্ম বেজে ওঠার কথা নয় কিন্তু তবু আমি কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করলাম, চারপাশে এক ধরনের সুনসান নীরবতা।
আমি আর জিগি পাশাপাশি দ্রুত হেঁটে যেতে থাকি। এই কেন্দ্রটি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা নেই, কোথায় যাচ্ছি ভালো করে জানি না তবুও এখান থেকে একটু দ্রুত সরে যেতে হবে। করিডরের অন্য মাথায় পৌঁছানোর আগেই অন্য পাশ থেকে দুটি সাইবর্গ হেঁটে আসতে দেখলাম, তাদের চোখে-মুখে সাইবর্গসুলত এক ধরনের উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি, আমি এবং জিগি মুহূর্তের জন্যে খুব বিপন্ন অনুভব করি কিন্তু সাইবর্গ দুটো আমাদের দুজনকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে গেল। ক্রানার সিকিউরিটি কার্ডটি সম্ভবত আমাদেরকে নিরাপদ মানুষ হিসেবে চারপাশে একটি সংকেত পাঠাচ্ছে।
সাইবর্গ দুটি পাশ কাটিয়ে বেশ খানিকটা দূরে সরে আসার পর জিগি তার বুকের মাঝে আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, এভাবে হাঁটা উচিত হচ্ছে না, যে কোনো মুহূর্তে ধরা পড়ে যাবে।
হ্যাঁ। আমি মাথা নাড়লাম, চলো কোথাও আগে লুকিয়ে পড়ি।