ক্লিশা বলল, সব এক সমতলে চলে এসেছে। এই এলাকাটার পরেই অন্য এলাকা, তোমাদের খুঁজে নিতে হবে।
তোমাদের কাছে কো–অরডিনেট নেই?
সার্কুলার কো-অরডিনেট, থাকলেই কী না থাকলেই কী?
আমি রিয়া এবং নুরিগার দিকে তাকিয়ে বলাম, চলো যাই।
রিয়া এবং নুরিগা আমার পিছু পিছু ঘর থেকে বের হয়ে এল। আমরা যখন করিডরে পৌঁছেছি ঠিক তখন নুরিগা হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে বলল, তোমরা একটু দাঁড়াও, আমি আসছি।
কোথা থেকে আসছ? আমার প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই সে প্রশস্ত ঘরটিতে ফিরে গেল, সেখানে প্রথমে একটু হটোপুটি তারপর শিরানের কাতর আর্তনাদ শুনতে পেলাম। প্রায় সাথে সাথেই নুরিগা ফিরে এসে বলল, শিরানের রক্তও লাল। বেশ লাল।
রিয়া হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল। এটি কৌতুককর কোনো ব্যাপার নয়, সত্যি কথা বলতে কী বেশ নৃশংস একটি ব্যাপার, তারপরও আমি হাসি আটকে রাখতে পারলাম না।
১১. ক্রানা
জিগি বলল, পুরো ব্যাপারটা একবার পর্যালোচনা করা যাক।
আমি মাথা নাড়লাম। জিগি বলল, তুমি এসে বললে তোমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করে তোমাকে এবং রাজকুমারী রিয়াকে পরাবাস্তব জগতে আটকে রাখা হয়েছে। তাদেরকে সাহায্য করার জন্যে আমি মূল নেটওয়ার্কে ঢোকার চেষ্টা করলাম, পারলাম না। উল্টো আমার আস্তানাটি ধ্বংস হল।
আমি আবার মাথা নাড়লাম। জিগি বলল, আমার তখনই থেমে যাওয়া উচিত ছিল, কারণ তোমার কিংবা রাজকুমারীর কিছু হয় নি তাদের ম্যাপিং বা পরাবাস্তব অস্তিত্বটি শুধুমাত্র আটকা পড়েছে। তারা যদি মারাও যায় তোমাদের কিছু হবে না–তোমরা ভালোভাবে বেঁচে থাকবে। কিন্তু এই সহজ যুক্তিটি আমার চোখে পড়ল না– আমি বোকার মতো আবেগপ্রবণ হয়ে গেলাম।
আমি আবার মাথা নাড়লাম।
জিগি বলল, আবেগপ্রবণ হলে মানুষ ভুল করে, আমিও ভুল করলাম। খুব বড় ভুল। পালানোর রাস্তা ঠিক না করে এখানে এসে হাজির হলাম। শুধু হাজির হলাম তা নয়, নেটওয়ার্কের পরিবর্তন করে ছয়টি পরাবাস্তব জগৎ এক সমতলে নিয়ে এসে তোমাকে এর ভেতরে ঢুকিয়ে দিলাম। তখন একটা কেলেঙ্কারি হল–আমরা একেবারে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেলাম। এখন আমাদের কী হবে জানি না।
আমি আবার মাথা নাড়লাম। জিগি বিরক্ত হয়ে বলল, শুধু মাথা নাড়বে না, কিছু একটা বলো।
বলার বিশেষ কিছু নেই।
অন্ততপক্ষে বলল যে তুমি খুব দুঃখিত।
আমি দুঃখিত না হলে কেন মিছিমিছি বলব যে আমি দুঃখিত?
জিগি রেগে উঠে বলল, তোমার একটি পরাবাস্তব অস্তিত্বের জন্যে আমরা এত বড় একটা গাড়ায় পড়েছি–তুমি সেজন্যে দুঃখিত হবে না?
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, না
কেন না?
সেটা আমি বলতে পারব না
কেন বলতে পারবে না?
কারণ আমি নিশ্চিত আমাদেরকে খুব তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করা হচ্ছে।
অবিশ্যি লক্ষ করা হচ্ছে। কিন্তু কোন ব্যাপারটি এখানে গোপন যেটা আমরা জানি কিন্তু ওরা জানে না?
আমি জিগির কথার উত্তর না দিয়ে বললাম, তোমার কাছে একটা চাকু আছে?
জিগি অবাক হয়ে বলল, না, কেমন করে থাকবে? আমাদের ব্যাগগুলো রেখে দিয়েছে!
খুব ছোট চাকু? যেটা বিপজ্জনক নয়?
জিগি তার প্যান্টের অনেকগুলো পকেট ঘেঁটে একটা ছোট চাকু বের করল, কষ্ট করে এটি দিয়ে ফলমূলের ছিলকে কাটা যেতে পারে। আমি চাকুর ধারটা পরীক্ষা করে বললাম, চমৎকার!
কী চমৎকার?
চাকুর ধারটুকু।
কেন?
আমি ঠিক করেছি আত্মহত্যা করব।
জিগি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, এরকম সময়ে ঠাট্টা তামাশা ভালো লাগে না।
আমারও ভালো লাগে না– এবং সে কিছু বলার আগেই আমি কবজিতে মূল ধমনির ওপর চাকু বসিয়ে দিলাম, নিখুঁত কাজ, সাথে সাথেই ধমনি কেটে ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হতে লাগল। আমি অবাক হয়ে লক্ষ করলাম যেরকম যন্ত্রণা হবে ভেবেছিলাম, সেরকম যন্ত্রণা হচ্ছে না।
জিগি চিৎকার করে আমার হাত ধরে ফেলল, কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা দুজনে রক্তে মাখামাখি হয়ে গেলাম। আমি যথাসম্ভব শান্ত গলায় বললাম, এত ব্যস্ত হবার কিছু হয় নি। আমি যদি মরে যাই শুধুমাত্র তা হলেই তুমি বেঁচে যেতে পারবে।
কেন? কেন একথা বলছ? কারণ আমি বেশি জেনে ফেলেছি–তোমার সেটুকু জানার দরকার নেই।
আমি কথা শেষ করার আগেই একটা এলার্মের শব্দ শুনতে পেলাম এবং কিছুক্ষণের মাঝে দরজা খুলে একজন ডাক্তার ছুটে এল। আমি নিশ্বাস বন্ধ করে ডাক্তারটির মুখের দিকে তাকালাম, যা আশা করেছিলাম তাই, ডাক্তারটি জানা। তার সাথে যোগাযোগ করার জন্যেই আমি আমার ধমনিটি কেটেছি রক্তপাতটুকু বৃথা যায় নি।
ক্ৰানা আমার ওপর ঝুঁকে পড়ল, কী আশ্চর্য! এটা কোন ধরনের নির্বুদ্ধিতা?
হাতের টিস্যু জোড়া লাগানোর যন্ত্রটি একটি চাপা গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে, আমি সেই শব্দের আড়ালে কানার সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলাম। ফিসফিস করে বললাম, ক্রানা এটা নির্বুদ্ধিতা না, তোমার সাথে যোগাযোগ করার এটা আমার একমাত্র উপায়।
ক্রানা কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি ফিসফিস করে বললাম, আমাদের খুব বিপদ। পৃথিবীর খুব বিপদ। আমাদের এখান থেকে বের হওয়ার সুযোগ করে দাও।
ক্রানা আমার ধমনিটি জোড়া লাগিয়ে রক্তপাত বন্ধ করে ফিসফিস করে বলল, কেমন করে সেটা করব?
তোমার সিকিউরিটি কার্ড আছে সেটা আমাদের দিয়ে যাও।