পারি না। ক্লিশার কথা শেষ হবার আগেই নুরিপা তাকে আঘাত করে বসে এবং ক্লিশা ছিটকে গিয়ে দেওয়ালে আছড়ে পড়ল।
কী করছ তুমি নুরিগা– বলে রিয়া ক্লিশার কাছে ছুটে যায় এবং তাকে কোনোভাবে টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দেয়। বেকায়দা আঘাত লেগে তার নাক থেকে দরদর করে রক্ত পড়ছে।
নুরিগা হিংস্র চোখে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, মানুষের সাথে ভালো ব্যবহার কী করে করতে হয় আমি জানি না। আমাকে যেটা শেখানো হয়েছে সেটাই করছি।
রিয়া মাথা নেড়ে বলল, না নুরিগা, তুমি এটা করতে পার না। মানুষকে আঘাত করতে হয় না।
আমি দুঃখিত রিয়া। কিন্তু আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। তা ছাড়া তোমরাই বলেছ এটা পরাবাস্তব জগৎ। এখানে আমরা সবাই নকল। সবাই কৃত্রিম। সবাই কিছু তথ্য।
কিন্তু আমাদের অনুভূতিটি সত্যি।
আমি একমাত্র অক্ষত মানুষ শিরানের কাছে এগিয়ে গিয়ে বললাম, দেখো শিরান তুমি মনে হয় ব্যাপারটির গুরুত্ব বুঝতে পারছ না।
বুঝতে পারছি। কিন্তু আমাদের কিছু বলার নেই।
আমি কঠিন গলায় বললাম, এই শেষবার তোমাকে বলছি, তুমি আমাদের বাইরে যোগাযোগের ব্যবস্থা করে দাও।
আমরা পারব না।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে বললাম, নুরিগা, তুমি এদেরকে একটু চোখে চোখে রাখ, আমি দেখি কী করতে পারি।
শিরান ভয়ার্ত গলায় বলল, তুমি কী করতে চাও?
এই রাবাস্তব জগতের সাথে পৃথিবীর একটা যোগসূত্র আছে। সেটা খুঁজে বের করে নষ্ট করতে চাই।
শিরান চমকে উঠল, বলল, অসম্ভব।
মোটেও অসম্ভব নয়। আমাকে তোমরা মোটেও গুরুত্ব দাও নি–কিন্তু এসব কাজ আমি খুব ভালো পারি। আমি পুরো পরাবাস্তব জগতের সব তথ্য ওলটপালট করে দেব। তোমাদের এতদিনের কাজ, গবেষণা এক সেকেন্ডে আবর্জনা হয়ে যাবে।
শিরান এবং তার সাথে অন্য দুজন তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ঘরের চতুষ্কোণ মডিউলটির উপর উঠে ভেতরে উঁকি দিলাম। অনেকগুলো প্রি–প্রসেসরের পাশে বড় বড় হিটশিল্ড লাগানো কিছু প্রসেসর। হোট ঘোট ক্রিস্টাল বসানো আছে দেখে বোঝা যায় অবলাল রশ্মি ভেতর দিয়ে ছোটাছুটি করছে, আমি টেবিল থেকে একটা স্কু ড্রাইভার নিয়ে দুটো ক্রিস্টালের মাঝে রাখতেই ভ্রু ড্রাইভারটি ভস্মীভূত হয়ে গেল, সাথে সাথে মুহূর্তের জন্যে চারদিক অন্ধকার হয়ে যায়, দূরে কোথাও একটা ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেল!
শিরান আমার দিকে ছুটে এসে বলল, কী করছ আহাম্মকের মতো? কী করছ তুমি?
আমি মুখে মধুর হাসি ফুটিয়ে বললাম, দেখতেই পারছ কী করছি। চেষ্টাচরিত্র করে পরাবাস্তব জগৎটা উড়িয়ে দিতে চাইছি!
তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
না, হয় নি। খুব ঠাণ্ডা মাথায় কাজ করছি। তোমরা যদি আমার কথা না শোন এবারে আমি বড় প্রসেসরটা টেনে তুলে ফেলব, আমার হাতটা হয়তো কাবাবের মতো ঝলসে যাবে কিন্তু পরাবাস্তব জগতের কোন অংশটা ধ্বংস হবে বলো দেখি?
শিরান পেছন থেকে আমাকে জাপটে ধরে বলল, না, তুমি এটা করবে না। খবরদার ভয়ংকর ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। এত ভয়ংকর যেটা তুমি চিন্তাও করতে পারবে না
কেন? কী হয়েছিল?
একবার শরীরের অর্ধেক অংশ উড়ে গেল, সব মানুষের অন্য অর্ধেক ঠিক আছে। ব্যাপারটা চিন্তা করেই শিরান শিউরে ওঠে।
আমি সেরকম কিছু করতে চাই না। কাজেই বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের একটা ব্যবস্থা করে দাও। তাড়াতাড়ি।
শিরান তার লাল চুলে আঙুল দিয়ে কী ভাবল খানিকক্ষণ, তারপর এগিয়ে দেওয়ালের সাথে লাগানো কেবিনেটটি খুলে চতুষ্কোণ একটা ধাতব বাক্স নিয়ে আসে। আমার হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, সাড়ে তেরো টেরা হার্টজে সেট করে নিলে যোগাযোগ করতে পারবে।
চমৎকার! আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, এটা কি দ্বিপক্ষীয়?
না শিরান গোমড়া মুখে বলল, শুধু তথ্য পাঠাতে পারবে। তথ্য ফিরে আসবে না।
এর সাথে কি ট্র্যাকিং ডিভাইস আছে?
অবিশ্যি আছে, সব সময় থাকে। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে না?
তার মানে ব্যবহার করতে গিয়ে আমরা মারা পড়তে পারি?
শিরান কোনো কথা না বলে মাথা নাড়ল।
আমি একটা নিশ্বাস ফেলে ঘরে সবার দিকে তাকালাম, যে যেখানে ছিল সেখানে দাঁড়িয়ে স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি যুদ্ধজয়ের ভঙ্গি করে বললাম, এখন আমরা বাইরের পৃথিবীতে খবর পাঠাতে পারব। চলো যাই। তবে যাবার আগে আমাদের পরাবাস্তব জগতের আরো কিছু তথ্য দরকার। আমি রক্তাক্ত রিকি এবং ক্লিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, তথ্যগুলো কি তোমরা এমনি দেবে নাকি কিছু মারপিট করতে হবে?
ক্লিশা তার হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে মুখের রক্ত মুছে ফেলার চেষ্টা করতে করতে বলল, দেওয়ার মতো কোনো তথ্য নেই। সব মিলিয়ে ছয়টা ভিন্ন ভিন্ন স্তর আছে। এক স্তর থেকে অন্য কোনো স্তরে যাওয়া যেত না। কিছু একটা গোলমাল হয়েছে এখন যাওয়া যায়।
গোলমাল?
হ্যাঁ, মনে হল প্রোগ্রামিং স্তরে পরিবর্তন করেছে। বেআইনি পরিবর্তন।
আমি আনন্দে হা–হা করে হেসে বললাম, জিগি! জিগি?
হ্যাঁ, জিগি নামে আমার একটা বন্ধু আছে, সে হচ্ছে এই ব্যাপারে মহাওস্তাদ। আমি নিশ্চিত আসল ত্রাতুল আসল জিগিকে নিয়ে তোমাদের নেটওয়ার্কে হানা দিয়েছে।
আমার উচ্ছাসে অন্য কেউ অংশ নিল না। বরং ক্লিশা, রিকি আর শিরান তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি যোগাযোগ মডিউলটা হাতে নিয়ে বললাম, অন্য ছয়টি স্তরে কেমন করে যাওয়া যায়?