আমি ভেবেছিলাম আমাকে ওরা মুক্তি দিয়েছে। আমাকে আর শেকল পরে খাঁচার ভেতরে থাকতে হবে না। কিন্তু আসলে মুক্তি দেয় নি। এই অস্তিত্বকে মুক্তি দিয়েছে–যেই অস্তিত্বের কোনো অর্থ নেই, কোনো মূল্য নেই!
আমি নরম গলায় বললাম, আছে। মূল্য আছে।
কীভাবে মূল্য আছে?
আমি এখনো জানি না। কিন্তু মনে নেই ত্রাতুল তোমাকে দিয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছে।
কী খবর পাঠিয়েছে?
রক্তের রঙ লাল, সবুজ নয়।
তার অর্থ কী?
আমি এখনো জানি না–কিন্তু সেই অর্থ খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের জানতে হবে কার রক্ত লাল নয় সবুজ।
কীভাবে সেটি জানবে?
প্রথমে যাই নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে। লুকিয়ে থাকার দিন শেষ হয়েছে এখন সামনাসামনি প্রশ্ন করতে হবে।
নুরিগা তার চোখ মুছে উঠে দাঁড়াল, বলল, চলো।
আমি তার হাত স্পর্শ করে বললাম, নুরিগা!
কী?
তুমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ কথাটি আমি বিশ্বাস করি না।
নুরিগা একটু হাসল, বলল, তুমি এই কথাটি আগেও আমাকে বলেছ।
সত্যি?
হ্যাঁ। সত্যি। নুরিগা আমার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বলল, তোমাকে ধনবাদ। ত্রাতুল। এই একটি কথা কারো মুখ থেকে শোনা খুব প্রয়োজন ছিল।
ধন্যবাদ।
নুরিগা এবারে ঘুরে রিয়ার দিকে তাকাল, তারপর শোনা যায় না এরকম গলায় বলল, রিয়া আমি দুঃখিত যে তোমাকে আমি খুন করতে চেয়েছিলাম।
রিয়া হেসে ফেলল, আমার মনে হয় কিছু একটা করতে চাওয়া আর কিছু একটা করার মাঝে অনেক বড় পার্থক্য। আমি নাকি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ, কিন্তু আমার মাথায় কী চিন্তা আসে এবং আমি কী কী বিদঘুঁটে কাজ করতে চাই শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
নুরিগা অনেকটা আপনমনে বিড়বিড় করে বলল, আমি একটা জিনিস বুঝতে পারছি। আমাকে সব সময় বলা হয়েছে আমি খারাপ–আমাকে জঘন্য অপরাধ করতে হবে। কিন্তু এখন দেখছি সেটা সত্যি নয়। তোমাদের সাহায্য করব চিন্তা করেই আমার ভালো লাগছে। অন্য রকম একটা ভালো লাগার অনুভূতি!
হ্যাঁ। রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, আমার মনে হয় এটাই হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার গোপন কথা। অন্যের জন্যে কিছু একটা করা।
.
নেটওয়ার্ক কেন্দ্রে আমরা যখন পৌঁছেছি তখন বেশ বেলা হয়ে গেছে। পুরো এলাকাটির মাঝে এক ধরনের শান্ত এবং কোমল ভাব রয়েছে কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আজকে তার মাঝেও আমি এক ধরনের অস্থিরতা খুঁজে পেতে ক্ষ করেছি। কেন্দ্রের দরজায় আমি কোনো ধরনের নিরাপত্তা ব্যবস্থার আশঙ্কা করেছিলাম কিন্তু দেখা গেল সেরকম কিছু নেই। আমরা গেট খুলে ভেতরে ঢুকে গেলাম। লম্বা করিডর ধরে হেঁটে একটা প্রশস্ত ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে নুরিগা বলল, এই যে, এখান থেকে আমাকে যেতে দিয়েছে।
আমারও ঘরটির কথা মনে পড়ল, এখানেই আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং হয়েছিল। নুরিগা ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে দিতেই ভেতরের মানুষেরা ঘুরে আমাদের দিকে তাকাল, তাদের মুখে এক ধরনের বিষয়। আমি মানুষগুলোকে চিনতে পারলাম, এরা আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করেছিল। লাল চুলের শিরান নামের মানুষটি বলল, তোমরা? তোমরা এখানে কেন এসেছ?
আমি একটু এগিয়ে গিয়ে বললাম, বলছি কেন এসেছি। কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে আমাদের হাতে সময় খুব বেশি নেই। তাই কোনো ভূমিকা না করে আমরা সোজাসুজি কাজের কথায় চলে আসি।
শিরান, রিকি বা ক্লিশা কেউ কোনো কথা বলল না, এক ধরনের স্থির চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি একটা নিশ্বাস নিয়ে বললাম, আমরা জানি এটা পরাবাস্তব জগৎ–এখানে আমরা সবাই কৃত্রিম, সবাই কোনো যন্ত্রের তথ্য। আমরা তথ্য হিসেবে থাকতে চাইছি না, আমাদের প্রকৃত অস্তিত্বের সাথে মিলিত হতে চাইছি। তাই আমরা সত্যিকার পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করতে এসেছি।
মানুষ তিনজন অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল, রিকি মাথা নেড়ে বলল, তোমরা কী বলছ আমি কিছু বুঝতে পারছি না।
আমি হেসে বললাম, তোমার কথা আমার কাছে খুব বিশ্বাসযোগ্য মনে হচ্ছে না।
নুরিগা হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে বলল, এরা সোজা কথা বুঝতে চায় না। আচ্ছা মতন রগড়ানি দিতে হবে। আমার চাইতে ভালো রগড়ানি কেউ দিতে পারে বলে মনে হয় না।
নুরিগা সত্যি সত্যি কিছু একটা করে ফেলে কি না সেটি নিয়ে আমি আতঙ্কিত হয়ে উঠে তাকে থামানোর চেষ্টা করে বললাম, মাথা গরম করো না নুরিগা, কথা বলে দেখা যাক।
নুরিগা তার অস্ত্রটি ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, তিনজনের একজনকে খুন করে ফেলি তা হলে অন্য দুটো সোজা হয়ে যাবে।
না না আগেই খুন করতে যেও না।
ঠিক আছে খুন না করতে পারি, কিন্তু রক্তের রঙটা তো পরীক্ষা করে দেখতে পারি বলে কিছু করার আগেই নুরিগা সামনে এগিয়ে হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে রিকির মুখে এত জোরে আঘাত করল যে সে এক কোনায় ছিটকে গিয়ে পড়ল। ঠোঁটের পাশে কেটে রক্ত বের হয়ে এল এবং হাত দিয়ে সেই রক্ত মুছে রিকি হতচকিতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল।
নুরিগা হিংস্র গলায় বলল, লাল, এই বদমাইশটার রক্ত লাল।
ক্লিশা ফ্যাকাসে মুখে বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। এই পরাবাস্তব জগতের নিয়ন্ত্রণে আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা সত্যিকার জগতে যোগাযোগ করতে পারি না।
আছে। আমি কঠিন মুখে বললাম, আমি গোপনে সাধারণ যন্ত্রপাতি ব্যবহার করেই বাইরের পৃথিবীতে যোগাযোগ করেছি। তোমরা নিশ্চয়ই পার।