কিন্তু–কিন্তু–।
আমি মেয়েটাকে বাধা দিয়ে বললাম, এই রোবট দুটি বেশিক্ষণ অচল থাকবে না। এক্ষুনি আবার সিস্টেম লোড করে নেবে। কাজেই আমার বেশি সময় নেই। আমি পকেট থেকে ছোট এবং ধারালো একটা চাকু বের করে হাতের ভেতরের দিকে নরম চামড়াটা একটু চিরে ফেলতেই সেখানে এক বিন্দু রক্ত বের হয়ে এল। রক্তের ওপর ছোট ট্রাকিওশানটি ভাসছে, খুব ভালো করে না তাকালে সেটি দেখা যায় না। আমি চাকুর মাথায় সাবধানে সেটি তুলে নিয়ে মেয়েটির দিকে এগিয়ে দিলাম। বললাম, এই যে আমার ট্রাকিওশান।
মেয়েটি কী করবে বুঝতে না পেরে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি ট্রাকিওশানটি খুব সাবধানে তার কোয়ার্টজের ডেস্কের ওপর রেখে বললাম, সাবধানে দেখে রেখো–হারিয়ে গেলে বিপদে পড়বে।
মেয়েটি ঠিক তখনো বুঝতে পারছে না কী হচ্ছে। আমার দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবট দুটির দিকে তাকিয়ে আমার দিকে ঘুরে তাকাল, বলল, তুমি যে কোনো রোবটকে অচল করে দিতে পার?
না। যে কোনো রোবটকে পারি না। নতুন সিস্টেম বের হলে একটু সময় লাগে।
কীভাবে কর?
চেষ্টাচরিত্র করে। কপোট্রনের গঠন জানা থাকলে পারা যায়। আমি মুখে হাসি টেনে বললাম, তুমি চাইলে তোমাকেও শিখিয়ে দিতে পারি! তৃতীয় প্রজন্মের যোগাযোগ রোবট খুব সোজা। একটা লাল কার্ড নেবে আরেকটা সবুজ। লাল কার্ডটা চোখের সামনে দুবার নাড়াবে তারপর সবুজ কার্ড একবার। তারপর বলবে দোহাই দোহাই এন্ড্রোমিডার দোহাই–নয়ের পর সাত চাই।
নয়ের পর সাত?
হ্যাঁ। দেখবে রোবট ফেঁসে গেছে। পুরো আড়াই মিনিট। আমি মুখে হালকা গাম্ভীর্য ফুটিয়ে বললাম, তবে সাবধান। আমি যতদূর জানি ব্যাপারটা হালকাভাবে বেআইনি। রোবটগুলোর মেমোরিতে থাকে না তাই ধরতে পারে না।
আমি পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রোবটটার সবুজ ফাটাসেলের চোখে হালকা আলোর বিচ্ছুরণ দেখতে পেলাম, যার অর্থ সেগুলো তাদের সিস্টেম লোড করতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মাঝেই সেগুলো জেগে উঠবে আমাকে তার আগেই চলে যেতে হবে। আমি ডেস্কের ওপর পাশে বসে থাকা মেয়েটির দিকে চোখ মটকে বললাম, বিদায়!
কিন্তু কিন্তু
মেয়েটি আরো কিছু একটা বলতে চেয়েছিল কিন্তু তার আগেই আমি বড় হলঘর পার হয়ে বাইরে চলে এসেছি। আমার শরীরে কোনো ট্রাকিওশান নেই–আমার সাথে এই মেয়েটি আর কোনোদিন যোগাযোগ করতে পারবে না। শুধু এই মেয়েটি নয়, পৃথিবীর আর কেউই যোগাযোগ করতে পারবে না।
.
চড়ুই পাখিটি আমার কাঁধ থেকে নেমে আমার হাতের তালুতে আশ্রয় নিয়ে হাত থেকে খুঁটে খুঁটে কয়েকটি শস্যদানা খাচ্ছিল, ঠিক এরকম সময়ে আমার সামনে ক্রুদ্ধ চেহারার একটি সাইবর্গ দাঁড়িয়ে গেল। তার মাথার ডানপাশে মস্তিষ্কের ভেতর থেকে কিছু। টিউব বের হয়ে এসেছে। বাম চোখটি কৃত্রিম, সেখানে ঘোলা লাল রঙের একটা আলো। সাইবর্গের দাঁতগুলো ধাতব। সে এক ধরনের যান্ত্রিক গলায় বলল, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ?
আমি তার দিকে না তাকিয়ে বললাম, তুমি কে? তুমি এখানে কী করছ–আমি কি সেটা জানতে চেয়েছি?
সাইবর্গটি ধাতব গলায় বলল, না।
তা হলে তুমি কেন জানতে চাইছ?
এটি স্বাভাবিক নয়। পৃথিবীর সব মানুষকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। তুমি তোমার দায়ি
আমি একটু কৌতূহল নিয়ে সাইবর্গটির দিকে তাকালাম, মস্তিষ্ক থেকে বের হওয়া টিউবগুলোতে কোম্পানির ছাপ দেওয়া রয়েছে। এটি সপ্তম প্রজন্মের ইন্টারফেস, এই সাইবর্গটির সিস্টেম অত্যন্ত ক্রটিপূর্ণ। আমি ইচ্ছে করলে চোখের পলকে এটিকে বিকল করে দিতে পারি। যন্ত্র অংশটি বিকল করে দেওয়া হলে তার মানব অংশটি কী করে আমার খুব জানার ইচ্ছে হল, কিন্তু আমি জোর করে আমার কৌতূহলকে নিবৃত্ত করলাম। শহরের মাঝামাঝি এলাকায় ভর দুপুরবেলা আমি একটা হট্টগোল শুরু করতে চাই না। কিন্তু সাইবর্গটি নাছোড়বান্দার মতো লেগে রইল, কণ্ঠস্বর এক ধাপ উঁচু করে বলল, তুমি এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি।
না দিই নি।
কেন?
কারণ প্রথমত আমার উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন নেই। দ্বিতীয়ত, আমি যদি উত্তর দিই তুমি সেটা বুঝবে না।
কেন বুঝব না?
কারণ তুমি একটা সাইবর্গ। সাইবর্গের বুদ্ধিমত্তার একটা সীমাবদ্ধতা আছে। একটা বিশেষ ধরনের উদ্দেশ্য নিয়ে সাইবর্গ তৈরি করা হয়েছিল এবং আমার ধারণা সেই উদ্দেশ্য পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে।
সাইবর্গটি তার গলার স্বর আরো এক ধাপ উঁচু করে আরো উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি কেন এই কথা বলছ?
কারণ তুমি সম্পূর্ণ বিনা প্রয়োজনে আমার সময় নষ্ট করছ। তোমার চেঁচামেচির কারণে আমার পোষা ইঁদুরটি লুকিয়ে গেছে। চড়ুই পাখিটি উড়ে ঐ বিল্ডিঙের কারনিসে বসে আছে। তুমি দূর হও।
সাইবর্গটি প্রায় মারমুখী হয়ে বলল, তুমি কেন আমার সাথে অপমানসূচক কথা বলছ? আমি তোমার সম্পর্কে মূল তথ্যকেন্দ্রে রিপোর্ট করে দেব।
আমার এবারে একটু ধৈর্যচ্যুতি হল–কাজেই আমি সাইবর্গটির চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ধু–ধু একটা প্রান্তর তার ঠিক মাঝখান দিয়ে একটা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।
সাইবর্গটির ভালো চোখটিতে হঠাৎ একটি আতঙ্ক ফুটে উঠল। কাঁপা গলায় বলল, কেন তুমি এ কথা বলছ?
পাথরটা ছয় টুকরো হয়ে গেছে। এখন ছয়টি ধু–ধু প্রান্তর। তার মাঝে ছয়টা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে।