মানুষটি তার অস্ত্র হাত বদল করল এবং একটা লিভার টেনে অস্ত্রটি পুরোটা রিসেট করে নিল, সেই শব্দে রিয়া হঠাৎ করে জেগে ওঠে। সে ধড়মড় করে উঠে বসল, বিস্ফারিত চোখে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, কে? কে তুমি?
মানুষটি মাথার এলোমেলো সোনালি চুলকে পেছনে সরিয়ে বলল, আমার কোনো নাম নেই। অনেকে নুরিগা বলে ডাকে। আমি হচ্ছি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষগুলোর জিন্স নিয়ে আমাকে তৈরি করা হয়েছে।
রিয়া কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইল। নুরিগা হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি শুনেছি পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হচ্ছ তুমি। তোমাকে দেখার একটা শখ ছিল।
রিয়া দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, এভাবে দেখা হবে আমি ঠিক বুঝতে পারি নি।
আমিও পারি নি। আমাকে সব সময় একটা খাঁচার মাঝে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখত। এখন কী মনে করে ছেড়ে দিয়েছে।
ছেড়ে দিয়েছে?
হ্যাঁ। শুধু ছেড়ে দিয়েছে তাই নয়, আমাকে একটা অস্ত্রও দিয়েছে। সেই অস্ত্র নিয়ে সারা রাত তোমাকে খুঁজছি।
আমাকে খুঁজছ?
হ্যাঁ। আমাকে বলেছে তোমাকে খুঁজে বের করতে। আমি অবিশ্যি সেজন্যে তোমাকে খুঁজি নি, নিজের কৌতূহলে খুঁজছি।
রিয়া শুকনো গলায় বলল, কিসের কৌতূহল?
দেখার কৌতূহল। প্রতিশোধ নেবার কৌতূহল।
প্রতিশোধ নেবার?
হ্যাঁ। দীর্ঘদেহী সোনালি চুলের মানুষটি তার অস্ত্রটি উদ্যত করে বলল, আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হিসেবে জন্ম নিতে চাই নি, কিন্তু আমাকে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হয়ে জন্ম নিতে হয়েছে এবং শিকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় জীবন কাটাতে হয়েছে। তুমিও পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো মানুষ হয়ে জন্ম নিতে চাও নি, কিন্তু তুমি সেভাবে জন্ম নিয়ে পৃথিবীর যত আনন্দ–সুখ সব ভোগ করছ। ব্যাপারটি ঠিক নয়–আমি সেই ত্রুটিটি শোধরাব।
কিছু বোঝার আগেই আমি দেখতে পেলাম নুরিগা তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি রিয়ার দিকে তাক করেছে। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, সাতদিন পর এভাবে তা হলে রিয়ার অস্তিত্বকে শেষ করে দেবার পরিকল্পনা করেছে? কিন্তু সেটি তো আমি হতে দিতে পারি না আমি নিঃশব্দে এগিয়ে পেছন থেকে মানুষটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লাম।
আমার আচমকা আঘাতে মানুষটি পড়ে গেল, তার হাতের অস্ত্রটি একপাশে ছিটকে পড়ল। আমি মানুষটিকে নিচে চেপে রেখে অস্ত্রটি হাতে তুলে নেবার চেষ্টা করলাম কিন্তু মানুষটির শরীরে অমানুষিক জোর, ধাক্কা দিয়ে আমাকে নিচে ফেলে দিয়ে সে হিংস্র ভঙ্গিতে আমার টুটি চেপে ধরে। তার শক্ত লোহার মতো আঙুল আমার গলায় সঁড়াশির মতো চেপে বসে। আমি প্রাণপণে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করি কিন্তু তার অমানুষিক শক্তির কাছে আমি একেবারে অসহায়। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, এবং এক ধরনের অক্ষম আক্রোশে আমি মানুষটির মুখের দিকে তাকালাম–সোনালি চুল এবং সবুজ চোখের মানুষটিতে কী ভয়ংকর জিঘাংসা–
হঠাৎ করে মানুষটির হাত আলগা হয়ে গেল। সে আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে বলল, তুমি? তুমি এখানে?
আমি কাশতে কাশতে কয়েকবার বুক ভরে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে করতে বললাম, তুমি আমাকে চেনো?
মানুষটি অবাক হয়ে বলল, কেন চিনব না? তুমি ভ্রাতুল। একটু আগেই তো তোমার সাথে কথা বললাম!
আমি মানুষটির দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সত্যিকার ভাতুলের সাথে এই মানুষটির যোগাযোগ হয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটির সাথে তার কেমন করে যোগাযোগ হল?
নুরিগা নামের মানুষটি আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি এখানে কেমন করে এসেছ?
আমি গলায় হাত বুলিয়ে বললাম, সে অনেক বড় ইতিহাস।
নুরিগা মাথা নেড়ে বলল, তোমার সব কাজ, সব কথাবার্তা হেঁয়ালিপূর্ণ, তুমি সোজা ভাষায় কথা বলতে পার না?
কেন, কী হয়েছে? আমি কী বলেছি?
তুমি একটু আগে আমাকে বললে, রক্তের রঙ লাল।
তাই বলেছি? আর কী বলেছি?
আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? নুরিগা বিরক্ত হয়ে বলল, তুমি জান না তুমি কী বলেছ!
তবু আমি তোমার মুখ থেকে শুনতে চাই।
বলেছ রক্তের রঙ সবুজ নয়। বলেছ আবার যখন দেখা হবে তখন সব বুঝিয়ে বলবে।
আমি নুরিগার দিকে তাকিয়ে রইলাম, নুরিগা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, আবার দেখা হল এখন বুঝিয়ে বলল।
আমি কাঁপা গলায় বললাম, বলব। অবিশ্যি বলব। আমাকে একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে দাও।
ঠাণ্ডা মাথায় কী ভাবতে চাও?
আমার কাছে যে তথ্যটা পাঠানো হয়েছে।
কে তথ্য পাঠিয়েছে?
আমি পাঠিয়েছি।
তুমি পাঠিয়েছ? তুমি কার কাছে পাঠিয়েছ?
আমি আমার কাছে পাঠিয়েছি।
নুরিগা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
.
রিগাকে প্রকৃত ব্যাপারটি বোঝানো খুব সহজ হল না। বোঝনোর পরও সে আমাদের কথা বিশ্বাস করল না। শেষ পর্যন্ত যখন সে বিশ্বাস করল তখন তার প্রতিক্রিয়াটি হল অত্যন্ত বিচিত্র। প্রথমে এক ধরনের অবর্ণনীয় আতঙ্ক এবং শেষে এক ভয়ংকর ক্রোধ। ক্রোধটি কার ওপর সে জানে না, একবার মনে হল প্রচণ্ড আক্রোশে সে রিয়া এবং আমাকেই শেষ করে দেবে কিন্তু শেষ পর্যন্ত নিজেকে সামলে নিল। ক্রোধটি শান্ত হয়ে যাবার পর তার ভেতরে। এক বিচিত্র দুঃখবোধ এসে ভর করল। আহত পশুর মতো সে দুই হাতে নিজের মাথা আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। রিয়া গভীর মমতায় তার হাত ধরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কেন কাঁদছ নুরিগা?