জিগি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, বলল, তুমি কী বলছ?
ঠিকই বলছি।
কী ঠিক বলছ?
নুরিগাকে নিচ্ছে তার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করতে। তাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠাবে। সম্ভবত আমার আর রিয়ার অস্তিত্বকে খুন করার জন্যে।
খুন করার জন্যে?
হ্যাঁ। তাই তাদেরকে বাঁচানোর চেষ্টা করছি।
বাঁচানোর চেষ্টা? কীভাবে?
নুরিগাকে দিয়ে আমার অস্তিত্বের কাছে একটা খবর পাঠালাম।
কী খবর?
আমি বিড়বিড় করে বললাম, রক্তের রঙ লাল।
জিগি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
১০. পলাতক জীবন
আগুনটাকে খুঁচিয়ে তার শিখাটাকে একটু বাড়িয়ে দিলাম, রিয়া দুই হাতে সেখান থেকে খানিকটা উষ্ণতা নেওয়ার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি কখনোই চিন্তা করি নি আমাকে এভাবে বন্য পশুর মতো লুকিয়ে থাকতে হবে।
আমি খুব দুঃখিত রিয়া।
কেন? তুমি কেন দুঃখিত ত্রাতুল?
আমার সাথে তোমার দেখা হল বলেই তো এই যন্ত্রণা। আমিই তো প্রথম বুঝতে পেরেছি যে এটা আসলে পরাবাস্তব জগৎ আমরা আসলে কৃত্রিম! যদি সেটা তুমি না জানতে তা হলে তোমার চমৎকার গেস্ট হাউজে আরামে থাকতে
একটা সত্য না জেনে আরামে থেকে কী হবে?
তোমার তাই ধারণা?
হ্যাঁ। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, আমার মনে হয় সত্য কথাটা জানা খুব দরকার। জেনে হয়তো লাভ থেকে ক্ষতি বেশি হয় কিন্তু তবুও জানা দরকার। সত্য হচ্ছে সত্য।
কিন্তু এটা কী ভয়ংকর একটা ব্যাপার! তুমি চিন্তা করতে পার আমরা কোনো একটা যন্ত্রের ভেতরে রাখা কিছু তথ্য? বিশ্বাস করতে পার?
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, পারি না।
সে আরো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, আমিও কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম, কোনো একটা বন্য পশু দূর দিয়ে ছুটে পালিয়ে গেল। আমি গোপন তথ্যকেন্দ্রের কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে সত্যিকারের ত্রাতুলের কাছে খবর পাঠানোর পর থেকে আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর লোকজন হন্যে হয়ে খুঁজছে। আমরা সেই থেকে বনে–জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
রিয়া একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে বলেছিল এখানে সাতদিন থাকতে হবে। আজ তো সাতদিন হয়ে যাবে–এখন কী করবে বলে মনে হয়?
হয়তো তোমার স্মৃতিকে তোমার সত্যিকার অস্তিত্বে স্থানান্তর করে দেবে।
রিয়া চমকে উঠে বলল, আর তোমাকে?
আমি তুচ্ছ মানুষ সাধারণ মানুষ। আমার অস্তিত্বকে নিয়ে টানাহ্যাঁচড়া করবে না।
তা হলে? তা হলে কী হবে?
যন্ত্রের মাঝে রাখা সেই তথ্যগুলো মুছে দেবে–আমিও মুছে যাব।
রিয়া এক ধরনের যন্ত্রণাকাতর মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মনে হল সে আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছে না। সে মাথা নেড়ে বলল, না না, এ কী করে হয়?
আমার রিয়ার জন্যে এক ধরনের মায়া হল। তার দিকে তাকিয়ে নরম গলায় বললাম, তুমি এসব নিয়ে মাথা ঘামিও না। যা হবার হবে।
রিয়া খপ করে আমার দুই হাত ধরে বলল, কী বলছ তুমি যে, যা হবার হবে? তোমার কিছু একটা হলে আমার কী হবে?
তোমার কিছুই হবে না। আমাদের এই কয়দিনের জীবন একটা স্বপ্নের মতো। তুমি কি স্বপ্নে দেখা কোনো মানুষের জন্যে কষ্ট পাও?
না। রিয়া মাথা নেড়ে বলল, এটা স্বপ্ন না। এটা সত্যি।
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। রিয়ার দিকে তাকিয়ে বুকের মাঝে সম্পূর্ণ নতুন এক ধরনের কষ্ট অনুভব করতে থাকি। এই অনুভূতির নামই কি ভালবাসা! রিয়ার সুন্দর মুখটির দিকে তাকিয়ে নিশ্চয়ই আমার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছিল, কারণ রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল তুমি হাসছ কেন?
আমি বললাম, হঠাৎ একটা কথা মনে হল তাই।
কী কথা?
সত্যিকারের রিয়া আর সত্যিকারের ত্রাতুলের কথা।
তাদের কী কথা?
সত্যিকারের পৃথিবীতে সত্যিকারের রিয়া হচ্ছে রাজকুমারী রিয়া–আর সত্যিকারের ত্রাতুল হচ্ছে একেবারে তুচ্ছ একজন মানুষ। তারা একজন আরেকজনকে চিনেও না। যদি তাদের মাঝে স্মৃতি স্থানান্তর না হয় তা হলে তারা কোনোদিন জানতেও পারবে না এই। পরাবাস্তব জগতে তারা কত কাছাকাছি দুজন মানুষ।
রিয়া আমার দিকে তাকিয়ে রইল, আমি দেখলাম তার চোখে পানি টলটল করছে, সে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে বলল, এটা চিন্তা করে তুমি হাসছ? হাসতে পারছ?
আমি রিয়াকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললাম, তুমি হচ্ছ পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষ, তোমার অনুভূতি পৃথিবীর সবচেয়ে পরিশুদ্ধ অনুভূতি! আমার বেলায় সেটা অন্যরকম, যেটা আনন্দের নয় তার মাঝেও কেমন জানি কৌতুক খুঁজে পাই।
রিয়া মাথা নাড়ল, বলল, না, তুমি ওরকম করে কথা বলো না, কখনো বলো না।
আমি কোনো কথা না বলে আগুনের শিখার দিকে তাকিয়ে রইলাম।
.
খুব ভোরবেলা হঠাৎ করে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আগুনের পাশে কুণ্ডলী পাকিয়ে রিয়া শুয়ে আছে। আমি একটা গাছে হেলান দিয়ে বসে ছিলাম, কখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। আমার মনে হল কোনো একজন মানুষের পায়ের শব্দ শুনতে পাচ্ছি, শুকনো পাতা মাড়িয়ে কে যেন এগিয়ে আসছে। ভোরের আবছা আলোতে দেখতে পেলাম একজন। দীর্ঘদেহী মানুষ রিয়ার দিকে এগিয়ে আসছে–মানুষটি এক হাতে আলতোভাবে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ধরে রেখেছে।
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলাম, মানুষটি নিঃশব্দে রিয়ার কাছে এগিয়ে এল, ঘুমন্ত রিয়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আবার সোজা হয়ে দাঁড়াল, আবছা আলোতে দেখা যাচ্ছে কিন্তু আমার স্পষ্ট মনে হল তার মুখে এক ধরনের হাসি ফুটে উঠেছে। মানুষটি আমাকে দেখে নি, আমি নিঃশব্দে তার দিকে এগিয়ে যেতে থাকি। যদি সে রিয়াকে আঘাত করার চেষ্টা করে আমার তাকে উদ্ধার করতে হবে। এটি পরাবাস্তব জগৎ হতে পারে, আমাদের অস্তিত্ব কৃত্রিম হতে পারে কিন্তু মানুষগুলো সত্যি।