হয় না। তৈরি করতে হয়। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করতে হয়।
তোমাকে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করেছে?
হ্যাঁ। মানুষটি আমার দিকে তাকিয়ে হাসার মতো ভঙ্গি করল এবং সেটি দেখে আমি আবার শিউরে উঠলাম। মানুষটির সোনালি চুল এবং সবুজ চোখ, অত্যন্ত সুগঠিত দেহ, উঁচু চোয়াল এবং খাড়া নাক। মানুষটির চেহারায় একটি অত্যন্ত বিচিত্র পাশবিক ভাব রয়েছে, দেখে এক ধরনের আতঙ্ক হয়। মানুষটি একটি নিশ্বাস ফেলে বলল, অনেক গবেষণা করে আমাকে তৈরি করেছে। আমার মনে হয় মোটামুটি নিখুঁতভাবেই তৈরি করেছে।
জিগি আমার পাশে এসে দাঁড়িয়ে কৌতূহল নিয়ে মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, কেন একথা বলছ?
কারণ আছে বলেই বলছি। যেমন মনে কর
কী?
তোমরা দুজন ঘরে আসতেই আমি প্রথমেই ভাবলাম কীভাবে তোমাদের খুন করা যায়।
খুন করা যায়?
হ্যাঁ। ভেবে বের করেছি।
তুমি বলতে চাও তুমি এই খাঁচার ভেতর থেকে আমাদের দুজনকে খুন করতে পারবে?
হ্যাঁ।
কীভাবে?
মানুষটি কোনো কথা না বলে আবার হাসল এবং আমি হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম সে সত্যি কথা বলছে। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, আমার নাম ব্রাতুল। জিগিকে দেখিয়ে বললাম, ও হচ্ছে জিগি।
মানুষটি এক ধরনের অবহেলার ভঙ্গি করে হাত নাড়ল। নিজে থেকে নাম বলল না বলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, তোমার নাম কী?
আমার নাম কী তাতে কিছু আসে–যায় না। যে পরিবেশে একজন মানুষের নাম ব্যবহার করতে হয় আমাকে কখনো সেখানে যেতে দেওয়া হবে না। কাজেই আমার নামের কোনো প্রয়োজন হয় না।
তুমি কি বলতে চাইছ তোমার কোনো নাম নেই?
মাঝে মাঝে আমাকে নুরিগা বলে সম্বোধন করে। এটা আমার নাম কি না আমি জানি না।
তোমার সাথে পরিচিত হয়ে সুখী হলাম নুরিগা।
বাজে কথা বোলো না। আমার সাথে পরিচিত হয়ে কেউ সুখী হয় না। আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ? কী আশ্চর্য!
নুরিগা ঘুরে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, কেন? আশ্চর্য কেন?
কারণ পৃথিবীতে একজন সবচেয়ে নিখুঁত মানুষও আছে–তার নাম রিয়া। তাকেও জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তৈরি করা হয়েছে।
নুরিগা খানিকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ আমি শুনেছি। আমি যেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ, সেরকম পৃথিবীর সবচেয়ে ভালো একজন মানুষ আছে। সবচেয়ে ভালো এবং নিখুঁত।
আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, হ্যাঁ আছে।
তার সাথে আমার দেখা করার খুব ইচ্ছে করে।
হঠাৎ আমার বুক কেঁপে উঠল, আমি শুকনো গলায় বললাম, কেন?
কৌতূহল।
তার সাথে দেখা হলে তুমি কী করবে?
নুরিগা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, খুন করব। খুন করায় এক ধরনের আনন্দ আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিখুঁত মানুষটিকে খুন করার সবচেয়ে নিখুঁত আনন্দ।
নুরিগা হঠাৎ শব্দ করে হাসতে শুরু করে, সেই ভয়ংকর হাসি শুনে আমি পিছিয়ে আসি। ভয়ার্ত চোখে আমি জিগির দিকে তাকালাম। জিগি প্রশ্ন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল, বলল, কী হয়েছে?
আমি ফিসফিস করে বললাম, না, কিছু হয় নি। আমার শুধু মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
এরা নুরিগাকে পরাবাস্তব জগতে পাঠাবে।
কেন?
জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে তাকে নিশ্চয়ই পাঠাবে।
জিগি কোনো কথা না বলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
নুরিগা, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষটি তার ছোট খাঁচার ভেতরে বসে হাত এবং পায়ের শিকল নাড়িয়ে বিচিত্র এক ধরনের গান গাইতে থাকে, সেই গানে সুর বা মাধুর্য কিছুই নেই কিন্তু তবুও শুনতে কেমন যেন আনন্দ হয়। আমি এবং জিগি ঘরের দেওয়ালে হেলান দিয়ে সেই গান শুনতে শুনতে অপেক্ষা করতে থাকি। ঠিক কিসের জন্যে অপেক্ষা করছি জানি না বলে সেটি হয় খুব দীর্ঘ এবং খুব কষ্টকর।
দীর্ঘ সময় পর হঠাৎ করে দরজা খুলে গেল এবং সরীসৃপের মতো দেখতে মানুষটি আরো কয়েকজন মানুষকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। নুরিগার খাঁচাটিকে তারা যন্ত্রপাতি দিয়ে ধরে টেনে বাইরে নিতে থাকে–নুরিগা কোনো রকম উত্তেজনা না দেখিয়ে চুপ করে বসে থাকে। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, বিদায় নুরিগা।
নুরিগা কোনো কথা বলল না, সে আমার কথাটি শুনেছে বলে মনে হল না। আমি আবার বললাম, নুরিগা, তুমি কিন্তু আসলে পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ নও।
নুরিগা আমার দিকে প্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল। আমি বললাম, প্রথম যখন আমরা তোমার। কাছে আসছিলাম, তুমি কী বলেছিলে জান?
কী?
বলেছিলে আমরা যেন তোমার বাঁচার কাছে না আসি। কাছে এলে শক খাব। তুমি আমাদের ইলেকট্রিক শক থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছিলে। খারাপ মানুষ কাউকে রক্ষা করে না।
নুরিগা বিভ্রান্তভাবে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোকে দেখিয়ে বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ হচ্ছে এরা যারা জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে তোমাকে তৈরি করেছে।
নুরিগার মুখ দেখে মনে হল সে কী যেন ঠিক বুঝতে পারছে না, আমি নরম গলায় বললাম, তোমাকে একটা জিনিস বলা হল না।
ততক্ষণে নুরিগাকে তার খাঁচার ভেতরে করে ঘরের বাইরে বের করে নিয়েছে। সে কৌতূহলী হয়ে উঠে দাঁড়াল, বলল, কী জিনিস?
রক্তের রঙ লাল।
কী বললে?
রক্তের রঙ লাল। সবুজ নয়—
আমি বুঝতে পারছি না তুমি কী বলছ।
ততক্ষণে নুরিগাকে অনেক দূর নিয়ে গেছে–আমি চিৎকার করে বললাম, আবার যখন দেখা হবে তখন বলব।