খ্রাউস তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তবে?
তবে পরাবাস্তব জগতে তোমার অস্তিত্বটির কিন্তু আশাভঙ্গ হয় নি। সে অত্যন্ত চমৎকৃত হয়েছে।
আমার কথা শুনে খ্রাউস বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠল, আমি দেখলাম তার সমস্ত মুখমণ্ডল মুহূর্তে রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে যায়, অনেক কষ্ট করে সে নিজেকে সংবরণ করে এবং জোর করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বলে, তাই নাকি?
হ্যাঁ। আমিও মুখে হাসি ফুটিয়ে বললাম, তোমার সাথে আমার পরিচয় হয় নি কিন্তু পরাবাস্তব খ্রাউসের সাথে আমার চমৎকার একটা পরিচয় হয়েছে। অত্যন্ত চমৎকার।
খ্রাউস অত্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা নিশ্বাস ফেলল, আমি দেখতে পেলাম তার চোখ দুটো মুহূর্তের জন্যে হিংস্র শ্বাপদের মতো জ্বলে উঠল। এই মানুষটি তার পরাবাস্তব অস্তিত্বের মতোই নিষ্ঠুর।
খ্রাউস মাথা ঘুরিয়ে পুরুষের মতো দেখতে মহিলাটির দিকে তাকিয়ে বলল, ক্লিশা তুমি নেটওয়ার্কটি দেখ–এর ভেতরের তথ্য বিকৃত হয়েছে কি না জানা দরকার।
আমি ক্লিশার দিকে তাকিয়ে বললাম, শুভ অপরাহ্ন ক্লিশা! আমি তোমাকে বলেছিলাম আবার আমাদের দেখা হবে–তুমি তখন আমার কথা বিশ্বাস কর নি। দেখা হল কি না?
ক্লিশা আমার দিকে বিষদৃষ্টিতে তাকাল, কোনো কথা বলল না। তার সাথে সাথে লাল চুলের মানুষটি এবং সরীসৃপের মতো মানুষটি যন্ত্রপাতির দিকে এগিয়ে গেল। জিগি তাদের কাছে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই নিরাপত্তা বাহিনীর মানুষগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র উঁচু করে তাকে থামাতে চেষ্টা করে। জিগি খানিকটা অবহেলায় অস্ত্রগুলো সরিয়ে বলল, শুধু শুধু বিরক্ত করো না–তোমরা খুব ভালো করে জান এই ঘরে তোমরা এই অস্ত্র ব্যবহার করতে পারবে না–তোমাদের শখের নেটওয়ার্ক নোড় তা হলে ধোঁয়া হয়ে উড়ে যাবে।
কথাটি সত্যি এবং তাই নিরাপত্তা বাহিনীর খুব অপমান বোধ হল, তারা তখন অস্ত্রের বাট দিয়ে জিগির মাথায় আঘাত করে তাকে নিচে ফেলে দিল। খ্রাউস হাত তুলে বলল, ওদের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত জানে মেরো না।
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকেরা খ্রাউসের কথামতো তাকে জানে না মেরে শারীরিকভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতায় কয়েকবার আঘাত করল। আমি দেখতে পেলাম জিগির ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়ে এসেছে কিন্তু সেটি উপস্থিত কাউকেই এতটুকু বিচলিত করল না।
ক্লিশা এবং তার দুজন সঙ্গী তাদের যন্ত্রপাতির ওপর ঝুঁকে পড়ে এবং কিছুক্ষণের মাঝেই তাদেরকে অত্যন্ত বিভ্রান্ত দেখাতে থাকে। খ্রাউস ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?
বুঝতে পারছি না। ক্লিশা আমতা–আমতা করে বলল, মনে হচ্ছে ভেতরে সব ওলটপালট হয়ে গেছে–সিকিউরিটির অংশটুকু ওভারলোড হয়েছে। ছয়টা স্তর আছে। সেগুলো এমনভাবে জট পাকিয়েছে যে–
যে?
আলাদা করাই মুশকিল।
খ্রাউসের মুখ ধীরে ধীরে রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সে হিংস্র দৃষ্টিতে একবার আমার দিকে আরেকবার জিগির দিকে তাকিয়ে দাতে দাঁত ঘষে বলল, কী করেছ তোমরা?
জিগি হাতের উল্টোপৃষ্ঠা দিয়ে ঠোঁটের রক্ত মুছে বলল, সেটাই তোমাদের বলতে চাইছিলাম, তোমার নির্বোধ বোম্বেটে বাহিনী বলতে দেয় নি। আমাকে আচ্ছামতো পিটিয়েছে।
ঠিক আছে, এখন বলো।
এখন একটু দেরি হয়ে গেছে। আমার আর বলার ইচ্ছে করছে না।
জিগি জোর করে একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পারলে তোমরা নিজেরা বের করে নাও।
ক্লিশা তাড়াতাড়ি করে বলল, মহামান্য খ্রাউস, আমরা এক্ষুনি বের করে ফেলছি। এই সব তুচ্ছ মানুষের কথায় কোনো গুরুত্ব দেবেন না।
খ্রাউস একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুচ্ছ মানুষের কথায় যেটুকু গুরুত্ব দেবার কথা তার থেকে বেশি গুরুত্ব আমি দিই না। তবে যেটুকু না দিলেই নয় সেটুকু গুরুত্ব আমি দিই।
খ্রাউসের কথায় কী ছিল আমি জানি না কিন্তু দেখতে পেলাম ক্লিশা আতঙ্কে কেমন যেন শিউরে উঠল।
খ্রাউস খানিকক্ষণ অন্যমনস্কভাবে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর কেমন যেন ক্লান্তভাবে একটা নিশ্বাস ফেলে নিরাপত্তা বাহিনীর একজন অফিসারকে বলল, এই দুজনকে কোনো একটি জায়গায় আটকে রেখো–আমার এদের সাথে কথা বলতে হবে।
নিরাপত্তা বাহিনীর অফিসারটি মাথা নেড়ে সাথে সাথেই আমাদের দুজনকে দু পাশ থেকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে।
.
আমাদের দুজনকে যে ঘরটিতে আটকে রাখল সেখানে আরো একজন মানুষকে আটকে রাখা হয়েছে। মানুষটির নিশ্চয়ই কোনো একটা বিশেষত্ব রয়েছে, কারণ তাকে একটা খাঁচার ভেতরে বন্ধ করে রাখা হয়েছে এবং তার হাত ও পা শিকল দিয়ে বাঁধা। মানুষটির মুখে এক ধরনের উদাস ভাব এবং আমাদের দুজনকে দেখে নিস্পৃহভাবে তাকাল। আমি এবং জিগি মানুষটির কাছে এগিয়ে গেলাম, কাছাকাছি যেতেই মানুষটি বলল–বেশি কাছে এস না, খাঁচার দেওয়ালে হাই ভোল্টেজ দিয়ে রেখেছে। শক খাবে।
আমরা থেমে গেলাম, খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন?
আমাকে ভয় পায়।
কেন?
কারণ আমি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ মানুষ।
সবচেয়ে খারাপ মানুষ?
হ্যাঁ। মানুষটি মুখে এক ধরনের হাসি ফুটিয়ে আমার দিকে তাকাল, আমি তার চোখের দিকে তাকিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করি। সেখানে ভয়ংকর একটি অমানবিক দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতরে এক ধরনের কাঁপুনি হতে থাকে। আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, মানুষ সবচেয়ে খারাপ কেমন করে হয়?