এটা পৃথিবী না। তা ছাড়া আমি কখনো কাউকে মহামান্য ডাকি না। আমি মুখের মাংসপেশি শক্ত করে বললাম, খ্রাউস, তোমার কি কখনো মনে হয়েছে যে এই কাজটি পৃথিবীর মানুষের কাছে অন্যায় এবং অমানবিক বলে মনে হতে পারে?
খ্রাউস আবার শব্দ করে হেসে উঠল, নিষ্ঠুর নীল দুটি চোখ দেখে আবার আমি আতঙ্কে শিউরে উঠলাম। খ্রাউস হাসতে হাসতে বলল, পৃথিবীর সাধারণ মানুষের কথা ভাবলে পৃথিবীতে কখনো সভ্যতা গড়ে উঠত না! মানুষ এখনো গুহায় বসে পাথরে পাথর ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে বুনো শূকর পুড়িয়ে পুড়িয়ে খেত। কিন্তু তা হয় নি। কেন হয় নি জান?
কেন?
কারণ পৃথিবীতে স্বপ্নদ্রষ্টা মানুষের জন্ম হয়েছে। তারা সাধারণ মানুষকে ব্যবহার করে, প্রয়োজনে ধ্বংস করে বড় বড় সভ্যতা গড়ে তুলেছে। পৃথিবীর সভ্যতার ইতিহাস হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস–একটি সভ্যতা ধ্বংস করে সব সময় আরেকটি সভ্যতা গড়ে উঠেছে। আমরা এখন ঠিক সেরকম একটা মুহূর্তের কাছাকাছি আছি। পৃথিবীর এই সভ্যতা ধ্বংস করে আমরা নতুন একটা সভ্যতা গড়ে তুলব। সে
ও! আমি মাথা নাড়লাম, বললাম, বুঝতে পেরেছি।
কী বুঝতে পেরেছ?
তুমি হচ্ছ ইতিহাসের সেই বিশ্বাসঘাতক। যে সব সময় নিজের জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে।
তোমার এসব কথা হচ্ছে অসভ্য মানুষের অশালীন ভাষা। অশালীন ভাষা ব্যবহার। করে তুমি আমাকে বিচলিত করতে পারবে না।
আমি জানি। কিন্তু তবু চেষ্টা করতে চাই।
নির্বোধ যুবক। তুমি জান তোমার জীবন শেষ হয়ে এসেছে।
সম্ভবত। আমি চোখ ঘুরিয়ে ঘরের চারপাশে তাকালাম। দেওয়ালে চমৎকার একটি শেলফ তৈরি করে তার ওপর কিছু প্রাচীন পুরাকীর্তি সাজিয়ে রাখা হয়েছে। কিছু মূর্তি, কিছু অলংকার। তৈজসপত্রের সাথে একটি লম্বা ধাতব দও সম্ভবত কখনো অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হত। আমি এগিয়ে সেটি হাতে তুলে নিলাম।
খ্রাউস প্রচণ্ড ক্রোধে চিৎকার করে বলল, তুমি কী করছ?
আমার এটা কৌতূহল। অশালীন ভাষা ব্যবহার করে তোমাকে বিচলিত করা যায় না, কিন্তু এই ভোঁতা দণ্ডটি দিয়ে তোমাকে ঠিকমতো আঘাত করে বিচলিত করা যায় কি না দেখতে চাই!
খ্রাউস অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, প্রথমে তার চোখে বিস্ময় এবং একটু পরে সেখানে এক ধরনের আতঙ্ক ফুটে ওঠে। আমি দুই হাতে ভোঁতা ধাতব দণ্ডটি শক্ত করে ধরে তার দিকে এগিয়ে গেলাম, খ্রাউস পিছিয়ে যাবার চেষ্টা করল কিন্তু তার আগেই আমি সমস্ত শরীরের জোর দিয়ে তাকে আঘাত করলাম। সে মাথা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করল, কিন্তু তার পরও দণ্ডটি তার মুখে এসে আঘাত করল। সাথে সাথে চোখের নিচে খানিকটা জায়গা ফেটে রক্ত বের হয়ে আসে।
খ্রাউস কাতর আর্তনাদ করে বলল, কী করছ? কী করছ তুমি?
আমি হিংস্র গলায় বললাম, দেখছি। পরাবাস্তব জগতে কাউকে খুন করা যায় কি না দেখছি।
আমি সত্যি সত্যি উন্মত্তের মতো আবার ধাতব দণ্ডটি তুলে তাকে আঘাত করার চেষ্টা করলাম, ঠিক তখন মনে হল আমার মাথার ভেতরে একটা বিস্ফোরণ ঘটল। হঠাৎ করে সবকিছু অদৃশ্য হয়ে যায় এবং আমি জিগির ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম–কী হয়েছে ত্রাতুল? কী হয়েছে তোমার?
আমি মাথা চেপে ধরে কোনোমতে উঠে বসার চেষ্টা করতে করতে বললাম, কিছু হয় নাই। একজনকে খুন করার চেষ্টা করছিলাম।
কাকে?
আমি উত্তর দেবার আগেই খুট করে দরজা খুলে গেল। দেখলাম সেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক মানুষ স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
পেছন থেকে একজন মানুষ হেঁটে আসছে। মানুষটির সোনালি চুল এবং নীল চোখ। মানুষটি মধ্যবয়স্ক এবং সুদর্শন।
মানুষটি খ্রাউস এবং আমি কয়েক মুহূর্ত আগে তাকে পরাবাস্তব জগতে খুন করার চেষ্টা করেছি।
০৯. খ্রাউস
নিরাপত্তা বাহিনীর কালো পোশাক পরা মানুষগুলো হেঁটে আমাদের খুব কাছে এসে দাঁড়িয়ে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রগুলো আমাদের দিকে তাক করে ধরল। যে কোনো একটি অস্ত্র দিয়েই তারা আমাকে ভস্মীভূত করে দিতে পারে, তার পরও কেন এতগুলো অস্ত্র আমাদের দিকে তাক করে রেখেছে সেটি একটি রহস্য!
নিরাপত্তা বাহিনীর লোকগুলোর পেছন থেকে খ্রাউস হেঁটে হেঁটে সামনে এসে দাঁড়ায়, আমি দেখতে পেলাম তার পেছনে আরো কয়েকজন মানুষ। তিনজনকে আমি বেশ ভালো করে চিনি–অত্যন্ত হৃদয়হীন এই তিনজন মানুষ আমার মস্তিষ্ক ম্যাপিং করেছিল, তারা এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। অন্যদের আমি চিনি না–ক্রানা নামের সেই ডাক্তার মেয়েটিকে খুঁজলাম কিন্তু তাকে দেখতে পেলাম না।
খ্রাউস খুব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমাকে এবং জিগিকে খানিকক্ষণ লক্ষ করল, তারপর একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, যখন শুনতে পেলাম পরাবাস্তব নেটওয়ার্কে কেউ ঢুকে গেছে তখন তাদের নিজের চোখে দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না।
জিগি কোনো কথা বলল না, যে কোনো জায়গাতে পৌঁছেই সে প্রথমেই পালিয়ে যাবার একটা ব্যবস্থা করে রাখে। এখানে সেটা করতে পারে নি বলে অত্যন্ত বিমর্ষ হয়ে আছে। আমি খ্রাউসের দিকে তাকিয়ে বললাম, দেখে কি তোমার আশাভঙ্গ হয়েছে?
নিশ্চয়ই হয়েছে। আমি ভেবেছিলাম দেখব খুব বুদ্ধিদীপ্ত তরুণ, তার বদলে দেখছি একেবারে আজেবাজে অপদার্থ ফালতু মানুষ।
তোমার আশাভঙ্গের কারণ হবার জন্যে খুব দুঃখিত। তবে আমি ইচ্ছে করে। বাক্যটা অসমাপ্ত রেখে থেমে গেলাম।