আমি বললাম, তোমার প্রশ্নের উত্তর দেবার আগে আমি কি ভেতরে আসতে পারি?
মানুষটার মুখে বিচিত্র এক ধরনের হাসি ফুটে ওঠে। সে দরজা থেকে সরে গিয়ে বলল, এস।
আমি ভেতরে ঢুকে মুগ্ধ হয়ে গেলাম, কী চমৎকার করে সাজানো ঘরটি, কোথাও এতটুকু বাহুল্য নেই, এতটুকু অসামঞ্জস্য নেই, শুধুমাত্র পরাবাস্তব জগতেই বুঝি এরকম চমৎকার একটি ঘর খুঁজে পাওয়া যায় আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি। সোনালি চুল, নীল চোখের মধ্যবয়স্ক মানুষটি এক ধরনের অবিশ্বাস নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, মুখে হতচকিত এক ধরনের বিস্ময় ধরে রেখে বলল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ? এখানে কারো আসার কথা নয়।
আমি জানি।
তা হলে তুমি কোথা থেকে এসেছ? কে তুমি?
আমার পরিচয় দিয়ে কোনো লাভ নেই। আমার নাম ত্রাতুল–কিন্তু সেটাও প্রমাণ করতে পারব না। তার চাইতে বলো তুমি কে? তোমার নিশ্চয়ই একটা পরিচয় আছে, তুমি নিশ্চয়ই খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ।
হ্যাঁ। আমি খুব গুরুত্বপূর্ণ একজন মানুষ। আমি এত গুরুত্বপূর্ণ যে আমার একটা অস্তিত্বকে আলাদা সরিয়ে রাখা হয়েছে। এখানে বেঁচে থাকার আনন্দের সবরকম উপকরণ আছে–তার মাঝে বাইরের কারো আসার কথা নয়। তুমি কেমন করে চলে এসেছ?
সম্ভবত ভুল করে। আমি মাথা নেড়ে বললাম, কিন্তু এসে যখন পড়েছি তোমার কাছ থেকে কিছু তথ্য নিয়ে যাই।
মানুষটার মুখে এক ধরনের উপহাসের হাসি ফুটে উঠল, বলল, কী তথ্য?
তুমি কে? তুমি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ?
মানুষটি মনে হল ঠিক বিশ্বাস করতে পারল না যে তাকে এই প্রশ্নটি করা হয়েছে। সম্ভবত কেউ তাকে এভাবে প্রশ্ন করে না। সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। আমি আবার বললাম, কে তুমি?
আমার নাম খ্রাউস। আমি এই পরাবাস্তব জগতের সৃষ্টিকর্তা।
আমি কিছুক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইলাম, তারপর দাঁতে দাঁত ঘষে জিজ্ঞেস করলাম, কেন তুমি এই পরাবাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছ?
আমি কাউকে এই প্রশ্নের জবাব দিই নি। কিন্তু তোমাকে দেব। কারণ তুমি সত্যিকারের মানুষ নও, তুমি পরাবাস্তব মানুষ। তোমাকে বললে কিছু আসে–যায় না।
কেন কিছু আসে–যায় না?
খ্রাউস হঠাৎ করে হেসে উঠল। হাসি অত্যন্ত বিচিত্র একটি প্রক্রিয়া, মানুষের ভেতরের রূপটি হাসির সাথে কেমন করে জানি প্রকাশিত হয়ে যায়। স্বাউসের হাসি দেখে আমি তাই শিউরে উঠলাম। হঠাৎ করে বুঝতে পারলাম মানুষটি অসম্ভব নিষ্ঠুর। আমার মনে হল মানুষ নয়, আমি বুঝি একটি দানবের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। খ্রাউস যেরকম হঠাৎ করে হেসে উঠেছিল সেরকম হঠাৎ করে থেমে গিয়ে বলল, কারণ তুমি কিছু বোঝার আগেই তোমাকে নিশ্চিহ্ন করা হবে! এই অস্তিত্বকে এবং তোমার সত্যিকার অস্তিত্বকে।
আমার ভয় পাওয়া উচিত ছিল কিন্তু কেন জানি ভয় না পেয়ে আমি ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলাম, বললাম, কে আমাকে নিশ্চিহ্ন করবে? তুমি?
না যুবক, তুমি বুঝতে পারছ না। তুমি কেমন করে এখানে ঢুকেছ আমি এখনো জানি, কিন্তু সেজন্য তোমাকে খুঁজে বের করে হত্যা করা হবে।
বেশ! তা হলে আমাকে হত্যা করে ফেলার আগেই আমি জেনে নেই–তুমি তা হলে বলো, কেন তুমি একটা পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করেছ?
আমাদের গ্যালাক্সিতে প্রায় এক মিলিয়ন বুদ্ধিমান প্রাণী থাকার কথা। এতদিন তাদের কারো সাথে আমাদের যোগাযোগ হয় নি কারণ আমরা যোগাযোগ করার মতো স্তরে পৌঁছাই নি। পিঁপড়ার সাথে মানুষ যেরকম যোগাযোগ করতে পারে না, অনেকটা সেরকম। শেষ পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ হয়েছে, বছর দুয়েক আগে।
পিঁপড়া থেকে উন্নত হয়েছে? পিঁপড়ার পাখা উঠেছে?
আমার টিটকারিটা উপেক্ষা করে খ্রাউস বলল, সেই উন্নত প্রাণীর সাথে আমাদের এক ধরনের শুভেচ্ছা বিনিময়ও হয়েছে। তারা আমাদের পরাবাস্তব জগৎ তৈরি করার মতো প্রযুক্তি দিয়েছে, তার বদলে আমরা তাদেরকে–
পৃথিবীর মানুষ দিচ্ছ?
খ্রাউস খানিকক্ষণ অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি ঠিকই অনুমান করেছ।
সেই মানুষটি হতে হবে পৃর্থিবীর নিখুঁততম মানুষ? সেজন্যে পৃথিবীর নিখুঁত মানবী তৈরি করছ?
খ্রাউস আবার চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল, তারপর বলল, তুমি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। তুমি যে এই পরাবাস্তব জগতে ঢুকে পড়েছ সেটা দেখে আমি এখন আর খুব অবাক হচ্ছি না।
এই পরাবাস্তব জগৎ সেই বুদ্ধিমান প্রাণীর সাথে যোগাযোগের ইন্টারফেসঃ প্রাচীন উপাসনালয়ের মতো দেখতে জায়গাটির ভেতর থেকে মহাকাশের প্রাণীদের সাথে যোগাযোগ করা হয়?
খ্রাউস এবারে হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করে বলল, তোমাকে আমি নতুন কিছুই বলতে পারলাম না। তুমি দেখছি সবই জান।
আমি শুধু একটি জিনিস জানি না।
কী জিনিস?
মানুষকে কোনো এক বুদ্ধিমান মহাজাগতিক প্রাণীর হাতে তুলে দেওয়ার সাথে তাদেরকে পরাবাস্তব জগতে সৃষ্টি করার সম্পর্ক কী?
তুমি কখনো চিড়িয়াখানায় গিয়েছ?
হ্যাঁ গিয়েছি।
চিড়িয়াখানায় বন্যপশু নিয়ে আসার আগে বনে–জঙ্গলে সেই পশুদের জীবনযাত্রা দেখে আসতে হয়। এখানেও তাই। যেসব মানুষকে পাঠানো হবে তাদের জীবনযাত্রা দেখা হচ্ছে। তাদেরকে নিয়ে খানিকটা গবেষণা করা হচ্ছে। তাদেরকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে।
আমি কিছুক্ষণ খ্রাউসের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, খ্রাউস।
পৃথিবীতে আমাকে মহামান্য খ্রাউস ডাকা হয়।