আমি তবুও ভয় পেলাম, কিন্তু পেলেও আর কিছু করার নেই। অস্ত্রোপচারের উঁচু টেবিলটাতে লম্বা হয়ে শুয়ে বললাম, নাও, কী করবে কর।
আমি আমার সমস্ত স্নায়ু শক্ত করে ভয়ংকর কিছু ঘটে যাবার জন্যে নিশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকি।
» ০৮. পরাবাস্তব জগৎ
আমি চোখ বন্ধ করে মনে মনে নিজেকে বললাম এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি আসলে কিছু বিচিত্র তথ্যের কৌশলী উপস্থাপনা, এখানে যা আছে তার কোনোটিই সত্যি নয় তাই আমি এর কিছুই দেখে অবাক হব না। তারপরও আমি চোখ খুলে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেলাম। আমার চারপাশে একটি বিচিত্র কুয়াশা ঢাকা আবছা জগৎ। কোথাও কোনো শব্দ নেই, মনে হয় নিজের নিশ্বাসের শব্দ আর হৃৎস্পন্দনও শুনতে পাব। জিগি বলেছিল এখানে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন পরাবাস্তব জগৎ রয়েছে কিন্তু এখানে একটি সুবিস্তৃত প্রান্তর ছাড়া আর কিছু নেই।
আমি খুব সাবধানে হাঁটতে থাকি, তখন মনে হল অনেক দূরে কোথাও একটি ঘণ্টা বাজছে শোনা যায় না এরকম একটি শব্দ। ঘণ্টাটি খুব গুরুগম্ভীর, মনে হয় কোনো একটি প্রাচীন মন্দিরের উপাসনার ঘণ্টা। আমি হাঁটতে হাঁটতে সামনে এগুতে থাকি, ঠিক তখন দূরে কিছু জিনিস স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মনে হয় একটি অতি প্রাচীন উপাসনালয়, আরো কাছে যাবার পর দেখলাম সেখানে মিটমিট করে বাতি জ্বলছে। আমি আরো কাছে এগিয়ে এলাম এবং তখন এই উপাসনালয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠল। অত্যন্ত বিচিত্র কারুকাজ করা দেওয়াল, পুরো স্থাপত্যটি একেবারেই অচেনা। আমি খানিকক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম, ভেতরে ঢোকার কোনো দরজা নেই। আমি একটু কাছে এসে দেওয়ালটা স্পর্শ করতেই সেটা পেছনে সরে গেল, ভালো করে তাকিয়ে দেখি ভেতরে ঢোকার মতো ছোট একটা জায়গা উন্মুক্ত হয়েছে। আমি সাবধানে ভেতরে ঢুকেছি তখন হঠাৎ করে মনে হল সরসর শব্দ করে কিছু একটা পেছনে সরে যাচ্ছে। ভেতরে বিশাল একটি কক্ষ, তার কারুকাজ করা দেওয়াল। আমি সেদিকে তাকিয়ে রইলাম এবং আমার মনে হল কারুকাজ করা দেওয়ালটি আস্তে আস্তে নড়ছে। আমার হঠাৎ করে মনে হল আমি জীবন্ত কোনো প্রাণীর সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আমার স্পষ্ট মনে হল আমি একটা প্রাণীর নিশ্বাস নেবার শব্দও শুনছি। নিশ্বাসের সাথে সাথে তার হৃৎস্পন্দন, দেহের সংকোচন, শরীরের কম্পনের শব্দ শোনা যেতে থাকে। জীবন্ত প্রাণীর এক ধরনের জৈবিক ঘ্রাণ আমার নাকে আসে, মনে হয় অশরীরী কোনো প্রাণী আমার দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে।
আমি চোখ বন্ধ করে নিজেকে বললাম, এটি একটি পরাবাস্তব জগৎ এটি সত্যি নয়। জিগি আমার শরীরের কাছে দাঁড়িয়ে আছে, ভয়ংকর কিছু ঘটলেই সে আমার ট্রাইকিনিওয়াল ইন্টারফেস টেনে খুলে দেবে, তখন আমি আবার সত্যিকারের জগতে ফিরে যাব। আমি চোখ বন্ধ করেই পায়ে পায়ে পিছিয়ে এসে দেওয়াল স্পর্শ করলাম। হাতের নিচে শীতল পিচ্ছিল জীবন্ত এক ধরনের অনুভূতি– আমি নিশ্বাস বন্ধ করে ধাক্কা দিতেই সেটি উন্মুক্ত হয়ে গেল এবং আমি নিশ্বাস বন্ধ করে প্রায় ছুটে বের হয়ে এলাম। আমার অস্তিত্বকে কি এরকম কোনো একটি জায়গায় বন্দি করে রেখেছে? আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর কুলকুল করে ঘামতে থাকে।
সে আমি চোখ খুলে তাকালাম, নিজের অজান্তেই ছুটে অনেক দূরে চলে এসেছি। উপাসনালয়ের মতো দেখতে প্রাচীন স্থাপত্যটিকে আর স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, শুধু বহুদূর থেকে এক ধরনের অস্পষ্ট রহস্যময় ঘণ্টার আওয়াজটি শোনা যাচ্ছে। আমি বুকভরে একবার নিশ্বাস নিলাম, কোথায় যেতে হবে কী করতে হবে কিছু বুঝতে পারছি না। এই পরাবাস্তব জগৎটি সত্যিকার জগতের মতো–এর থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।
ঠিক এরকম সময় বহু দূরে কোথাও একটি আলো জ্বলে আবার নিবে গেল। হয়তো এটি আমার জন্যে কোনো সংকেত, হয়তো আমার ওদিকে যাবার কথা। আমি বুকের মাঝে সাহস সঞ্চয় করে সেদিকে হাঁটতে থাকি।
আলোটি জ্বলে এবং নিবে আমাকে খানিকটা বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করল। হয়তো আলোটার দিকে সোজাসুজি যাচ্ছি হঠাৎ করে দেখতে পেলাম আলোটা ডানদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠেছে। ডানদিকে হাঁটছি, তখন আলোটা আবার বামদিকে সরে গিয়ে জ্বলে উঠল।
হেঁটে হেঁটে শেষ পর্যন্ত আমি আলোটা খুঁজে পেলাম। খুব আধুনিক ধরনের একটা ছোট বাসা, সেই বাসার ওপর একটি এন্টেনা এবং এন্টেনার ওপর একটি আলো–যেটি জ্বলছে এবং নিবছে, যে আলোটা দেখে আমি এখানে এসেছি। বাসাটির বাইরে একটি সাজানো লন, তার ভেতর দিয়ে নুড়ি বসানো রাস্তা চলে গেছে। আমি সাবধানে সেই রাস্তা ধরে হেঁটে হেঁটে বাসাটির কাছে চলে এলাম। বাসার ভেতর আলো জ্বলছে, মনে হয় সেখানে কেউ আছে। আমি দরজা স্পর্শ করতেই ভেতরে কোথাও শব্দ হল। আমি একজনের পদশব্দ শুনতে পেলাম, কেউ একজন এসে দরজা খুলে দিল, আমার দিকে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলল, কে?
আমি মানুষটিকে ভালো করে লক্ষ করলাম, এটি পরাবাস্তব জগতের পরাবাস্তব মানুষ, কিন্তু তার সাথে সত্যিকার মানুষের কোনো পার্থক্য নেই। মানুষটি মধ্যবয়স্ক, মাথার চুল সোনালি এবং চোখ নীল। গায়ের রঙ রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে গেছে, মুখে বয়স এবং অভিজ্ঞতার চিহ্ন। মানুষটি আবার জিজ্ঞেস করল, তুমি কে? কোথা থেকে এসেছ?