মেয়েটি নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সেটা বরং আমি বুঝতে পারতাম। আজকাল জীবন এমন পর্যায়ে চলে এসেছে যে মাঝে মাঝে মনে হয় মস্তিষ্ক ছাড়াই দিন বেশ কেটে যাবে! কিন্তু ট্রাকিওশান–ট্রাকিওশান ছাড়া তুমি কেমন করে থাকবে?
আমার ধারণা খুব আনন্দে থাকব।।
মেয়েটি ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কি মাদকাসক্ত?
না। আমি এই মুহূর্তে মাদকাসক্ত নই। আমি পুরোপুরি সুস্থ মানুষ। আমার ট্রাকিওশানটি পরীক্ষা করলে তুমি দেখবে আমি মানুষটি খুব গবেট নই।
তা হলে কেন ট্রাকিওশান ফেরত দিতে চাইছ? তখন তোমাকে খুঁজে পাবার কোনো উপায় থাকবে না। তোমার যদি কোনো জরুরি প্রয়োজন হয় যদি কোনো বিপদ হয়
ঠিক সেজন্যেই ফেরত দিতে চাইছি। আমি মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে বললাম, সব সময়ই কেউ না কেউ আমার ওপর নজর রাখছে, সেটা চিন্তা করলেই আমার রক্তচাপ বেড়ে যায়। আমি স্বাধীনভাবে থাকতে চাই।
মেয়েটি অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, স্বাধীনভাবে?
হ্যাঁ! প্রাচীনকালের মানুষের শরীরে ট্রাকিওশান ঢুকিয়ে দেওয়া হত না। তারা দিব্যি বেঁচে ছিল।
কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে লক্ষ লক্ষ মানুষ মেরে ফেলত। অদ্ভুত সব ভাইরাস আবিষ্কার করে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষ মেরে ফেলেছিল। মানুষকে ক্লোন করতে গিয়ে
মেয়েটিকে আমি যতটুকু বুদ্ধিমতী ভেবেছিলাম সে তার থেকে বেশি বুদ্ধিমতী– ইতিহাসের অনেক খবর রাখে। তাই আমি যুক্তিতর্কের দিকে অগ্রসর না হয়ে বললাম, তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু প্রাচীনকালের মানুষেরা সবাই সেরকম নির্বোধ ছিল না। তাদের মাঝেও অনেক ধাটি মানুষ ছিল। প্রথম আন্তঃনক্ষত্র অভিযানের ইতিহাসটুকু পড় নি? মানুষ সেখানে কী রকম বিপদের ঝুঁকি নিয়েছিল তুমি জান?
মেয়েটা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বিপদের ঝুঁকি নিতে চাও?
ইচ্ছে করে নিতে চাই না। কিন্তু একটা ট্রাকিওশান আমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখছে, একটা হাঁচি দিলেও দুটি বাইভার্বালে করে তিনটি চিকিৎসক রোবট পাঠিয়ে দিচ্ছে। আমি সেরকম অবস্থা থেকে মুক্তি চাই।
মেয়েটা একটা ছোট যোগাযোগ মডিউল অন্যমনস্কভাবে হাত বদল করে বলল, এটা নিশ্চয়ই বেআইনি?
আমি মাথা নাড়লাম, না, বেআইনি না। যারা চার মাত্রার অপরাধী তাদের জন্যে বেআইনি। আমার রেকর্ড একেবারে ঝকঝকে পরিষ্কার। ক্রিস্টালের মতো স্বচ্ছ।
মেয়েটা হাল ছাড়ল না, বলল, কিন্তু এটা শরীরের ভেতর থেকে বের করতে হলে নিশ্চয়ই চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হবে। চিকিত্সক রোবট লাগবে
তার কোনো প্রয়োজন নেই। আমি মধুরভাবে হেসে বললাম, তোমার চোখের সামনে আমি আমার হাতের চামড়া কেটে ট্রাকিওশানটা বের করে দেব।
মেয়েটা এক ধরনের অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল এবং আমি কিছু বলার আগেই সামনে রাখা একটা বোম স্পর্শ করে বলল, তুমি একটু দাঁড়াও, আমি দুজন প্রতিরক্ষা রোবটকে ডাকি।
আমি রোবটের সাহচর্য একেবারেই পছন্দ করি না। মানুষ–বড়জোর সাইবর্গকে আমি সহ্য করতে পারি কিন্তু ঠিক কী কারণ জানি না, আমি রোবটকে একেবারেই সহ্য করতে পারি না। আমি একটু ক্ষুব্ধ হয়ে বললাম, তুমি শুধু শুধু রোবটকে ডেকে পাঠালে। শুধু খানিকটা যন্ত্রণা বাড়ালে।
যন্ত্রণা বাড়ালাম? মেয়েটি একটু উষ্ণ হয়ে বলল, তোমার যদি কিছু একটা হয়?
আমি চোখের কোনা দিয়ে দেখতে পেলাম দুটি কদাকার রোবট দ্রুত পায়ে এদিকে এগিয়ে আসছে। কপালের পাশে কোম্পানির ছাপ এবং নম্বর, এগুলো চতুর্থ প্রজন্মের হাইব্রিড। কপোট্রনের নিউরাল নেটওয়ার্কে এদের তিন মাত্রার নিরাপত্তা বন্ধনী। রোবট দুটি নিঃশব্দে আমার দুপাশে এসে দাঁড়াল। আমি না তাকিয়েই বুঝতে পারি তাদের ফটোসেলের। চোখ তেইশ থেকে সাতচল্লিশ হার্টজে কাঁপতে শুরু করেছে। আমাকে রক্ষা করার জন্যে। এসেছে কিন্তু ব্যাপারটি পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা করা হয় নি আমাকে বিপদে ফেলে দেওয়া এদের জন্যে বিচিত্র কিছু নয়। ঝুঁকি নেওয়া আমার কাছে নিরাপদ মনে হল না। আমি মেয়েটির দিকে ঝুঁকে বললাম, গুগোলপ্লেক্স।
গুগোলপ্লেক্স? মেয়েটা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল। আমি মাথা নাড়লাম, কিংবা স্কুয়ের সংখ্যা। সেটিও হতে পারে।
কী হতে পারে?
স্মৃতির বিভেদ। ট্রানসেন্ডেন্টাল সংখ্যার উদাহরণ হতে পারে। এক চার এক পাঁচ নয় দুই ছয় পাঁচ তিন পাঁচ…
আমি প্রথম ত্রিশটা সংখ্যা বলা মাত্রই রোবট দুটি চাপা স্বরে গর্জন করে উঠল। বলল, খবরদার। তুমি থামো।
আমি থামলাম না, দ্রুত পরের দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করলাম এবং প্রায় সাথে সাথে ম্যাজিকের মতো কাজ হল। রোবট দুটি একেবারে মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেল। আমি ঝুঁকি নিয়ে সহস্রতম অংশ থেকে আরো দশটি সংখ্যা উচ্চারণ করে রাখলাম। মেয়েটি বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?
বিশেষ কিছু না। আমি রোবট দুটোকে অচল করে রাখলাম।
মেয়েটি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বলল, অচল করে রাখলে? কীভাবে?
তুমি যদি এই লাইনের লোক না হও তা হলে বুঝবে না। সব কপোট্রনেরই কিছু না কিছু সমস্যা থাকে। টেস্ট করার জন্যে রোবট কোম্পানিরা কিছু ফাঁকফোকর রেখে দেয়। সেগুলো গোপন থাকে না–বের হয়ে যায়। সেটা জানতে হয়–হিসাব করে সেটা ব্যবহার করা যায়।