রায়ীনা জানালাটিতে ধাক্কা দিয়ে কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে এসে ভিডিও স্ক্রীনটা চালু করল। সাথে সাথেই প্লিক্সি নেটওয়ার্কে সে পৃথিবীর কন্ট্রোল সেন্টার দেখতে পায়। কমান্ডার লী বড় একটা স্ক্রীনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। রায়ীনাকে দেখতে পেয়ে মুখে একটা হাসি টেনে এনে বলল, “চমৎকার ট্র্যাজেক্টরি। তুমি কক্ষপথে পৌঁছে গেছ।”
রায়ীনা মাথা নাড়ল। বলল, “হ্যাঁ।”
কমান্ডার লী বলল, “গ্রহকণাটা এখনো এগারো ঘন্টার পথ।”
রায়ীনা বলল, “বুঝতে পারছি।”
“প্রোগ্রাম লোড করা আছে। পৃথিবীটা একবার ঘুরে এসে ঠিক জায়গায় এলে তোমার রকেট চালু হবে।”
রায়ীনা একটু হাসল। বলল, “মহাকাশে ওপরে নিচে অনেকবার গিয়েছি, কিন্তু এই মিশনটা অন্যরকম।”
“হ্যাঁ, অন্যরকম।”
“প্রতিটা সেকেন্ড মূল্যবান।”
“যদি সময় থাকতো, তাহলে তোমাকে পৃথিবী কয়েকবার ঘুরিয়ে এনে ছেড়ে দিতাম। এখন একবারে এক্সেলেরেট করতে হবে-কষ্ট বেশি হবে।”
রায়ীনা হাসল। বলল, “আমার কষ্ট নিয়ে মাথা ঘামিও না। আমি জড় পদার্থের মতন, আমার কষ্ট হয় না।”
রায়ীনা কন্ট্রোল প্যানেলটাতে ধাক্কা দিয়ে আবার নিজেকে ভাসিয়ে জানালার কাছে নিয়ে আসে। জানালার হ্যাঁন্ডেলটা ধরে সে আবার নিচে পৃথিবীর দিকে তাকালো। নীল পৃথিবীটা ঘিরে সাদা মেঘ, অর্ধেক পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে এসেছে। আর কিছুক্ষণের মাঝে সেও পৃথিবীর অন্ধকার ছায়ার মাঝে ঢুকে যাবে। তখন পৃথিবীর অন্য একটা রূপ দেখা যাবে। বড় বড় শহরগুলোতে স্ফটিকের মতো আলো জ্বলজ্বল করছে, মহাকাশ থেকে কী অপূর্ব দেখায়।
রায়ীনা ঘড়ির দিকে তাকালো। পুরো পৃথিবীটা ঘুরে আসতে নব্বই মিনিটের মতো সময় নেয়। যার অর্থ, আর দশ মিনিটের মাঝেই সে পৃথিবীর কক্ষপথ ছেড়ে গ্রহকণার দিকে ছুটে যাবে। তার এখন মহাকাশচারীর সিটে বসা দরকার। তা না হলে একটু পরেই কর্কশ এলার্ম বাজতে শুরু করবে।
রায়ীনা ভেসে ভেসে তার সিটে গিয়ে বসল। দুই পাশ থেকে স্ট্র্যাপ এসে তাকে সিটের সাথে বেঁধে নেয়। সে হাত বাড়িয়ে কোয়াকম্পের সুইচটি অন করে দিল। এখন থেকে সে সরাসরি কোয়াকম্পের সাথে যোগাযোগ রাখতে চায়।
রায়ীনা আবার কমান্ডার লীয়ের গলার স্বর শুনতে পেল। কমান্ডার নিচু গলায় ডাকল, “রায়ীনা।”
“বল।”
“তুমি প্রস্তুত?”
“হ্যাঁ। আমি প্রস্তুত।”
“তোমার সাথে আমরা যোগাযোগ রাখব, কিন্তু এখন থেকে তোমার মহাকাশযানের দায়িত্ব তোমার।”
“আমি জানি।”
“আমরা অপেক্ষা করব। শুধু তুমি ডাকলে আমরা সাড়া দেব। আমরা নিজে থেকে তোমার সাথে আর কথা বলব না।”
“ঠিক আছে কমান্ডার। মিশনের এই পর্যায়ে এটাই হচ্ছে প্রোটোকল।”
“তাহলে বিদায় রায়ীনা।”
“বিদায়।” অভ্যাস মতো আবার দেখা হবে” বলতে গিয়ে রায়ীনা থেমে গেল। আবার দেখা হবে না। পৃথিবীর কারো সাথে আর দেখা হবে না।
.
রায়ীনা প্রথমে একটা গর্জন শুনতে পেলো। তারপর তীব্র একটা ঝাঁকুনি অনুভব করে। প্রায় সাথে সাথেই রায়ীনার মনে হলো, একটা ভারী পাথর বুঝি তার বুকের ওপর চেপে বসেছে। সে দাঁত দাঁত চেপে নিঃশ্বাস বন্ধ করে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝেই এই অদৃশ্য চাপটা সহনীয় হয়ে যাবে। হলোও তাই, রায়ীনা তখন সিট বেল্ট খুলে বের হয়ে এলো। জানালার কাছে এসে সে নিচের দিকে তাকালো। দূরে পৃথিবীটা দেখা যাচ্ছে। আস্তে আস্তে পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসবে। এই প্রথমবার পৃথিবীর জন্যে সে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। হঠাৎ করে তার ত্রাতিনার কথা মনে পড়ে যায়। এই মুহূর্তে সে কী করছে? যে শহরটি থেকে সে এসেছে, সেটি এখন পৃথিবীর উল্টোপিঠে। সেখানে এখন গভীর রাত। ত্রাতিনা কী তার জন্যে কাঁদছে? কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেছে? নাকি এখনো জেগে আছে? নূতন জায়গায় নূতন পরিবেশে সে কী ভয় পাচ্ছে? রায়ীনা জোর করে তার মাথা থেকে ভাবনাটা সরিয়ে দিল। তার এখন আবেগপ্রবণ হলে চলবে না। সে পৃথিবীকে রক্ষা করার মিশনে এসেছে। তার এখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যাকুল হবার সময় নেই।
ঘণ্টা দুয়েক পর হঠাৎ এলার্ম বেজে উঠল। রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কোয়াকম্প জানাচ্ছে, তার ইলন শাটলের জ্বালানি বিপজ্জনক মাত্রায় কমে আসছে। পৃথিবীতে নিরাপদে ফিরে যেতে হলে তার জ্বালানি হিসেব করে খরচ করতে হবে। রায়ীনাকে আর পৃথিবীতে ফিরে যেতে হবে না। তাকে তার জ্বালানি বাঁচিয়ে রাখতেও হবে না। কোয়াকম্প সেটি জানে না!
রায়ীনা এলার্মটি স্পর্শ করে বন্ধ করে মনিটরের দিকে তাকালো। সে গ্রহকণাটির কাছাকাছি পৌঁছে যাচ্ছে। এখন তাকে খুব সাবধানে গতি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। গ্রহকণাটির পাশাপাশি তাকে যেতে হবে এবং খুব সাবধানে গ্রহকণাটির ওপর নামতে হবে। কাজটি সহজ হবে না। কারণ গ্রহকণাটির আকার খুবই বিচিত্র এবং সেটি আরো বিচিত্রভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। রায়ীনাকে এখন আর পৃথিবীর তথ্য ব্যবহার করতে হবে না, সে নিজেই তার ইলন শাটল থেকে গ্রহকণাটির বিচিত্র গতিটাকে বিশ্লেষণ করতে পারবে। কোয়াকম্প তাকে সাহায্য করবে।
রায়ীনা আবার মহাকাশচারীর সিটে গিয়ে বসল। সাথে সাথে দুই পাশ থেকে নিরাপত্তা বন্ধনী আবার তাকে সিটের সাথে আটকে ফেলল। রায়ীনা তখন তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে, কন্ট্রোল প্যানেলটি নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে।